Saturday, October 22, 2011

বাসুর শেষ রাত

লোকটার অসহায় ভঙ্গি দেখে অনেকের মায়া হতে পারে, কিন্তু বাসুর হল না। সে একমনে ছুরিতে শান দিতে লাগল।


হাঁটু গেড়ে ও লোকটার সামনে বসল। আশেপাশে হালকা বাতাস বইছে ঠিকই, কিন্তু এতে লোকটার এতটা কেঁপে ওঠার কথা ছিল না। বাসু তার দমকা হাসিতে ফেটে পড়লো। ‘এমা, তুই তো ভয় খেয়ে আগেই মরে যাবি রে !’ হাসির দমকে লোকটার ভয় আরও বেড়ে যায়, কাঁপতে থাকে মৃগী রোগীর মত।


হঠাৎ দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে যায় বাসুর, মুখ খিচিয়ে বলে,' তাহলে আমি ছুরি ধার দিচ্ছি কেন হারামজাদা!
মরে গেলে আমার এই কষ্ট করে কি লাভ লাভ হবে? কি লাভ হবে!!!’ কাঁপতে কাঁপতে লোকটার গলায় ছুরির ডগা লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এই কুত্তার বাচ্চা, মরিস না, আজকে যমের কাছে আমি তোকে নিয়ে যাব। তোর পাসপোর্ট আমার হাতে, মনে রাখিস’।  


লোকটা কি বুঝল কে জানে, তবে খিঁচুনি থেমে গেল। নড়াচড়াই থেমে গেল বলতে গেলে।


বাসু আবার ছুরিতে শান দিতে মনোযোগ দিল। আরও কিছুক্ষণ পাথরে ঘষে নিলো। ‘ধার হয়েছে বটে বুঝলি...,’ধার দিতে দিতে বাসু বলতে লাগল, ‘সেবার এক চেয়ারম্যানের গলায় পোঁচ দিতে গিয়ে সেকি যন্ত্রণা হল! পোঁচ দেই, গলা কাটে না। আবার দেই, তাও কাটে না, খালি চামড়া খুলে আসে চাইনিজ মুরগীর মত। আমি শালার রাগের চোটে সেদিন কাজটাই করতে পারি নাই!’


আবার লোকটার সামনে এসে বসল। পরম বন্ধুর মত লোকটার কাঁধে হাতে রেখে বল, ‘ শোন, যেকোনো কাজ করার সময় নিয়মমতো করতে হয় বুঝলি, তাতে ব্যবসা হয়। ব্যবসা মানেই লাভ, খুশি, ক্যাশ, লালপানির ফোয়ারা, ভালবাসা, নাচ-গান...সব, সব! দুনিয়ায় তোর সব কাজেরই নিয়ম আছে, রাস্তা আছে। একবার বুঝতে পারলেই হল। খালি ও রাস্তায় যাবি আর তোর পাওনা নিয়ে আসবি। যাবি আর আসবি...যাবি আর আসবি...’


বাসু উঠে পায়চারী করতে লাগল। থেমে থেমে। কখনো লোকটার দিকে তাকায়, কখনো একমনে হাঁটে। ‘আমার মা কি বলত জানিস? পৃথিবীতে সব সুখ নাকি কোন একটা পুকুরে একটা বড় সিন্দুকে রাখা আছে। তুই আমি গেলেই নাকি ওটা পাব না। ওটা পেতে হলে তোকে সব কিছু ভুলে যেতে হবে, খালি মানুষের কথা ভাবতে হবে। মানুষকে সম্মান করতে হবে, মানুষের দুঃখ দূর করতে হবে...'।


একটু মুচকি মুচকি হাসে বাসু। ‘ আমি কিন্তু মানুষের দুঃখ দূর করি’। টুপ করে মাটিতে বসে লোকটাকে ঝাঁকাতে থাকে, ‘ কেমনে বলত? কেমনে? বল বল?’


লোকটা মুখ নিচু করে থাকে। কানের কাছে ভনভন করতে থাকা মাছি তাড়ানোর শক্তিও নেই তার।


বাসু আবার বলতে লাগল, ‘ এই যেমন ধর, তোর উপরে যার রাগ ছিল সে আমারে বলে দিল যে অমুকেরে ধরে পৃথিবী থেকে বিদায় কর। আমি ভাবলাম, লোকটা মনে হয় দুঃখু পাইছে তোর কাছ থেকে. আসলে আমার কাছে যারা আসে তারা আমার কাছে দুঃখ পেয়েই আসে। আমি তাদের দুঃখ দূর করে দেই। হে হে,’ বাসু হাসে, ‘ মাদার তেরেসাও ফেল!! ’


লোকটার হাঁটুর জখমে মাছি ভনভন করতে থাকে। লোকটা আবার বাঁধা হাত খোলার চেষ্টা করতে থাকে। বাসুর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আবার কি যেন মনে করতে থাকে।


‘ আজকে কেন জানি আমার মার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার মা খুব ভাল স্বাদের ভর্তা বানাতে পারত জানিস? শুঁটকি আমি কখনও খাইতে পারি না, আমার মুখে যায় না। অথচ আগে মা শুঁটকি  ভর্তা করলে আমার খাওয়াই শেষ হইতো না! এক টানে দুই-তিন থালা ভাত খেয়ে ফেলতাম। মা খালি হাসত আর আমার থালায় ভাত দিত ’।


হঠাৎ মাথা ঝাঁকাতে থাকে বাসু। ‘ যাহ্‌ শালা, তুই তো বড় খারাপ জিনিষ রে!! ’


চট করে লোকটার বাঁধন খোলে বাসু। লোকটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় একপাশে। ‘এই স্টিল মিলে আমি আর আসব না,’ বাসু জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে। দুরের নিওন আলোয় বাসুর কপালের ঘাম ঝিলিক মারতে থাকে । ‘ এ জায়গাটা পচে গেল। এখানে আসলেই এখন খালি আমার মায়ের কথা মনে পড়বে। এখন,’ লোকটাকে শুইয়ে ঠেসে ধরে বাসু, ‘ তোরে দিয়েই এখানকার পাটটা চুকায় ফেলি...’


লোকটা ছটফট করতে থাকে। মুখগোজা কাপড়ের  ফাঁকে তীব্র আকুতি জানায়। চোখের কাপড় ভিজে লাল মুখ একাকার হয়ে আসে।


বাসু ছুরিটা পোঁচ দেবার ভঙ্গিতে লোকটার গলার দিকে বাড়িয়ে রাখে, কিন্তু দেয় না। কি যেন ভাবে আবার। ‘ কি যে হল আমার, ধ্যাত!!!’ বলে লোকটার গায়ে লাথি মারে। গায়ে জড়ানো চাদরের নিচে থেকে বোতল বের করে হালকা চুমুক দেয়। ‘ আজকে আর হবে না। তুই আমার রেপুটেশনের চৌদ্দটা বাজায়া দিলি রে...’


বাসু আবার কি যেন বলতে থাকে। এবার আর জোরে নয়, বিড়বিড় করে। কি যেন বলে আর হাসে। মাঝে মাঝে বোতলে চুমুক দেয়। দেয়ালের থামে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। লোকটাকে চেঁচিয়ে ‘ শালা হারামির বাচ্চা!! ’ বলে গালি দিয়েই ঝিমুতে থাকে।
বাইরে হালকা বাতাস বইতে লাগল। উত্তুরে বাতাস? হতে পারে।


__________২_______________


শাওনের জবানবন্দি:


কিভাবে ওখান থেকে বের হয়েছিলাম সেটা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। কতদূর হেঁটেছি তাও জানি না।অনেকক্ষণ পরে যখন আলো দেখলাম, তখন দৌড়ে আলোর কাছে ছুটে গেলাম। মিলের দারোয়ানের রুমের আলো। দারোয়ানটা ঝিমচ্ছিল। আমি কোনমতে ওর কোলের উপরে গিয়ে পড়লাম। বললাম ‘ভাই, আমারে বাঁচান’।এরপর আর কিছু মনে নেই।


হসপিটালে জ্ঞান ফেরার পর কেবল বাসুর কথাই মনে পড়েছে। কাউকে কিছু বলি নাই, পুলিশি জেরায় খালি কিভাবে ওখানে এলাম, সেটারই বর্ণনা দিয়েছি কেবল। সবাই আপাতত আমার সুস্থতা নিয়েই চিন্তা করতে লাগল।


তিনদিন পর বাসুর খবর পেলাম। পেপারে এসেছে। সাথে বাসুর বড় করে একটা ছবি।  সকালে আমাকে উদ্ধারের পর ওখানে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়, তারপর গোডাউনটাতে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় ওকে পাওয়া যায়। ও ওখানে কি করছিল সে বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করছে।


আমি পত্রিকায় দেয়া বাসুর ছবিটা দেখলাম। ছুরিবিদ্ধ বাসুর ছবি। মুখে একটা মুচকি হাসির রেখা। ওই রাতের হাসির চাইতে বেশি সুন্দর। 




এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন।লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।

ঘুমনামা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...