Sunday, October 24, 2010

চিরচেনা... চিরঅচেনাঃ পর্ব-৪

                                        ...............।৪।..............


অন্তু সদরঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

এই জায়গাটা একসময় খুব ভালো লাগতো। সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চ-স্টীমার, পাচঁ মিনিট পরপর বিকট শব্দ...পোঁওওওও..., আর হাজার হাজার মানুষের হাজার রকমের ব্যস্ততা।হাজার রঙ্গে বোনা এখানকার প্রতিটি মুহূর্তগুলো সদরঘাটের এই মাল্টিকালার বৈচিত্র না থাকলে এই পুরোন ঢাকার ইতিহাসটাই ঢাকা পড়ে যাবে।

অনেক গরম পড়েছে। অন্তু ইতিমধ্যে দুটো ডাব খেয়ে ফেলেছে, আরেকটা খাবে কিনা ভাবছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না তার। যাবে নাকি কোথাও? স্টীমারে যেতে অন্য রকম একটা মজা আছে, অন্তু সেটা গতবার স্টাডী ট্যুরে গিয়েই বুঝেছে। সামনের ডেকে উঠে বাতাস খাওয়া, মাঝে মাঝে দু-এক কাপ চা খাওয়া...আর আশেপাশের দৃশ্যগুলোর ছবি তো মুফ্‌ত ।কম খরচে অনেক মজার একটা ভ্রমন।

আজ অবশ্য মজা লাগছে না। সকালে ফোন বন্ধ করার পর সিমটাও খুলে ফেলে দিয়েছে সে। বাসার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। অন্তত কিছুদিনের জন্য সব ভুলে যেতে চায় অন্তু। এমন কোথাও যেতে চায় যেখানে তাকে কেউ অন্তত খুঁজে পাবে না।

এখানে অবশ্য আকে খুঁজে পাওয়াটা সোজা। বাপি ইচ্ছে করলেই বের করতে পারবে সে এখানে এসেছিলো কিনা। তাতে অন্তুর আপত্তি নেই। বের করতে চাইলে করুক, কোথায় যাচ্ছে, তাও জানুক, কিন্তু তাকে বাসায় ফিরে না যেতে বললেই হবে।ওটা আর তার জন্যে বাসা নয়, নরকখানা।

গেটে দিয়ে ঢুকলো অন্তু। এক টাকা ভাংতি পাবে কোথায় গেটম্যান, তাই পুরো পাঁচ টাকাই নিয়ে নিল। ভিতরে ঢুকেই বাকি টাকা গুলো পকেটে ঢুকাতে যাবে, এমন সময়...
' স্যরি...'
' স্যরি আমি...আরে ! আপনি? '
' হ্যা...কিন্তু তুমি এখানে...কি করে...'
'আমি আজকে বাসায় যাব।আমার বাড়ি চাঁদপুর ।'
' ও।'
' কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? ' 
' আমি? আমি...' কি বলবে অন্তু? বিস্ময়ের ধাক্কাটাই কাটছে না এখন পর্যন্ত। এই মেয়েটার সাথে তার দেখা হলো মাত্র দুই দিন, কিন্তু এই দুই দিনই একেবারে বাস-ট্রাক সংঘর্ষ ! এখনো বুঝতে পারছে না অন্তু কি বলবে।'...আমি এমনিতেই এসেছি...তেমন কোন কারণ নেই...'
' অ। আমি ভাবলাম কোথাও যাবেন হয়তো...' ব্যাগটা টানতে টানতে বললো।ভারী মনে হচ্ছে ব্যাগটা। একটু হেল্প করবে নাকি...? না,থাক। পর মুহূর্তেই আবার...
' আমি ব্যাগটা ধরবো? '
' না না, আমি পারবো।'
' অ।' একটু হাঁপ ছেড়েই বাচলো অন্তু । ব্যাগ টানার কথা বলেই নিজে একটু লজ্জাই পেল। এটা কেন বলতে গেল? ওতো নিজেরটা নিজেই টানতে পারছে, তাই না?
লঞ্চ ঘাটে এসে পড়েছে। এই লঞ্চেই যাবে মেয়েটা? 
' আমি তাহলে আসি। '
'আচ্ছা, আবার দেখা হবে।'
'তাতো হবেই, কলেজে তো যাবেন, তাইনা?'
'হ্যা, হবে নিশ্চয়ই। বাই...।'
' বাই।' বলে কেন যেন আনমনেই হাসলো মেয়েটা। অন্তু খেয়াল করলো না। কিছুক্ষন পর অন্তুও হেসে উঠলো। কেন হাসলো দুজনের কেউ কি জানে?


                                  ............।৫।............

লঞ্চের টিকিট কাউন্টারের বসে থাকা মৌলভী মতন লোকটা অনিমাকে চেনে। প্রথমবার আসার সময় বাবা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো।'এটা ভাই আমার মেয়ে, ঢাকায় পড়াশোনা করে। আপনাদের এই লঞ্চেই আসা যাওয়া করবে। আসা যাওয়ার পথে একটু খেয়াল রাইবেন।'
বিগলিত একটা হাসি দিয়ে লোকটা বলেছিলো, 'চিন্তা করবেন না ভাই সাহেব। আপনার মেয়ে তো আমাদের মেয়ের মতোই। কোন সমস্যা নাই, আমি খেয়াল রাখবো।এক ফোঁটা আচঁড় ও লাগবে না"।এরপর থেকে এই লঞ্চে উঠলে এই লোকটা ক্রমাগত বিরক্ত করে। কারণে-অকারণে এসে  কেবিনে বসে। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয় ।''মা তোমার কি লাগবে বলো, আমি তোমাকে এনে দেব।'
'আমার কিছু লাগবে না চাচা।'
'লাগবে লাগবে। এই দুনিয়ায় মেয়ে মাইনষের সবচেয়ে বেশি জিনিষপাতি লাগে। আওরতের চাহিদা ছিলো বইলাই তো আমরা দুনিয়ায়, তাইনাগো মা জননী...?'
'এখন কিছু লাগবে না, লাগলে আমি আপনাকে বলে আসবো।'
'আইসো, আইসো।চিন-পরিচিতের মধ্যে কেউ না থাকলে আর কারো কাছে কইয়ো না মা। লঞ্চের মানুষগুলা ভালো না। এরা গন্ধে গন্ধে আসে, গন্ধ শুইকা চইলা যায়। কারো লগে মিশবা না মা্‌, আমি তো আছিই...'

আজকেও ঠিক একই রকম অবস্থা। দেখেই যেই একটা হাসি দিলো, তাতে পারলে যেন বত্রিশ দাঁতের সবগুলো বের হয়ে আসবে। পানের পিক ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। 'কেমন আছো মা, ভালো...?'
'হুম। একটা টিকিট দিন, কেবিনের দিবেন।'
'কেবিনের টিকিট তো নাই।'
'নাই?'
'না মা, আজকে লঞ্চ পুরাই ভর্তি।পাবলিক এক ঈদ বাদে এমন ভীড় করে না। আজকে মানুষের কোন গোনা-গুণতি নাই, সব উইঠা পড়ছে।'
কি করবে এখন অনিমা? যাওয়াটা খুব দরকার, মার অসুখ আবার বেড়েছে। বাবাকে কালকে খুব বিষণ্ন শোনাচ্ছিলো।"তোর মার অপারেশন করানোটা খুব জরুরীরে অনি..."

'কেন আব্বা, আর কয়েকদিন পরে করানো যায় না? মিন্টু চাচা কি বললো?'
'কি আর বলবে, বললো এবার চিকিৎসা না করতে পারলে তোর মা হয়তো...'
'ও। বাবা,একটা কথা বলি?'
'বল।'
'উত্তর পাড়ার জায়গাটা বেঁচে দিলে হয়না ?'
'ওটাতো কবেই...। '
লাইনটা কেটে গিয়েছিলো। সম্ভবত মোবাইলে টাকা নেই।অনিমা আর কিছু না বলে আজকে বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিল। আর আজকেই কিনা ঢাকা শহরের সব মানুষকে এই লঞ্চে উঠতে হবে?

'একটা কেবিন কোনভাবে ম্যানেজ করা যায় না ?'
'ম্যানেজ...হ্যা' আবার একটা হাসি দিলো আইজুদ্দিন।'আছে, একটা আছে ঠিকই।'
আছে? কোনটা চাচা? কত লাগবে ?
'ইয়া আল্লাহ, মেয়েটা বলে কি?'জিহবায় কামড় লাগায় সে। 'তোমার জন্যে টাকা লাগবে কেন? তুমি এমনিতেই যেতে পারবা...পুরাই ফ্রি !'
'মানে?'
'মানে আবার কি? আমার একখান রুম আছে না...?ওইখানে থাকলেই হবে, কোন সমস্যা হবে না...'
আবার শুরু হয়ে গেলো। 'না চাচা।অনেক ধন্যবাদ, আমার লাগবে না।'

'আহা, এমন কর কেন...রাগ করলে চলে ? কোন সমস্যা হবে না, তুমি আমার রুমে থাকবা...।'
'না। আমি কোন একটা ব্যাবস্থা করে নিতে পারব,' বলে দ্রুতপায়ে সেখান থেকে চলে গেলো। লোকটাকে দেখতেই তার এখন অসহ্য লাগছে।

দোতলায় চলে গেলো অনিমা। এখানে সবাই নিচে পাটি- চাদর পেতে বসে। তার এলাকাটা ছোট, খুব সহজেই পরিচিত কাউকে পেয়ে যাবে।ওইতো যুঁথি আপারাই তো ওখানে বসে আছে।অনিমা তাড়াতাড়ি ওদের ওখানে চলে গেল।

'আপা কেমন আছেন?'
'আরে অনিমা যে? কেমন আছিস?'
'এইতো আপা। বাড়ি যাচ্ছো ? '
'নারে...বাড়ি এবার উঠবো না, শ্বশুড় বাড়ি উঠবো। আমার ছোট ননদের বিয়ে, তাই ছুটি নিয়ে যাচ্ছি।এইযে দেখছিস না রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে? এ হচ্ছে আমার বড় ভাসুর। ডাক্তার মানুষ, চর্মরোগের ডাক্তার। ঢাকায় চারটা বাড়ি। পাশে যে দেখছিস হ্যাংলা করে ছেলেটা, ওটা আমার বরের চাচাত ভাই।আজকাল কিসব গান গায়, কিচ্ছু বুঝি না ছাই!...'

কান ঝালাপালা হয়ে গেল অনিমার।পুরো রেলিং জুড়েই খালি এতো আত্মীয়!। না বসাই তো ভালো ছিলো !
"তারপর দেখছিস না ওই ছেলেটা ওটা হচ্ছে...আরে? এটা না, এটা কেউ না।তারপর যে আছে..."

কিন্তু যে যুথি আপার কেউ না, তার দিকেই চোখ আটকালো অনিমার।

এই ছেলেটা লঞ্চে কেন?
                                                                                       (চলবে)


 


(এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন।লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।)

Monday, October 18, 2010

চিরচেনা...চিরঅচেনাঃ পর্ব-২

                                              ||--------৩-------||

আজকে সকাল বেলাতেই এত রোদ উঠে গেলো ! সারাদিনে তাহলে কি হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে যখন ঘড়িটার দিকে চোখ গেলো তখন অন্তু তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। দশটা বাজে ! বড্ড দেরী হয়ে গেল... আজকে সে ক্লাসে যেতে পারলো না । মম তো একবার হলেও উঠিয়ে দিয়ে যায়...

কিন্তু মম থাকলে তো বাপির সাথে কথা কাটাকাটি হতো।
মম কোথায়? কাল বাড়ি আসে নি?

"আজম চাচা ! আজম চাচা !" ডাকতে ডাকতে অন্তু নিচে নেমে আসলো। বাপির গাড়ি নেই,তারমানে বাপি অফিসে চলে গেছে। কিন্তু মমের গাড়ি তো নেই। ওয়েট, শফিক ভাই তো ঠিকই আছে...তাহলে মম গাড়িসহ আবার কোথায় গেলো?

আজম গাছে পানি দিচ্ছিল।ডাক শুনে কলটা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে গেলো। হাতটা মুছতে মুছতে বললো, "উঠেছ তাহলে?আমিতো ভাবলাম একবার গিয়ে জাগিয়ে আসবো নাকি..."

"মম কোথায়?"

কি যেন চিন্তা করলো আজম।এক মুহূর্ত ভেবে বললো," তোমার মা অফিসে।"
"কিন্তু শফিক ভাই তো বাসায়।"
"তোমার মা একাই গাড়ি নিয়ে গেছেন।"বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো আজম।
অন্তুর ভয়ানক রাগ হলো। "আজম চাচা, আমার দিকে তাকাও।"আজম তার দিকে তাকাল।
"মম কোথায় ? সত্যি করে বলবে।"
"আমি জানি না অন্তু। আমাকে জিজ্ঞেস কোর না, আমি জানি না।"
অন্তু আর কিছু বলল না। নিজের ঘর চলে গেলো। বাপিকে ফোন করতে হবে, বাপিকেই জিজ্ঞেস করতে হবে।

মোবাইলে বাপির নাম্বারটা রাখে না অন্তু। কিন্তু এই নাম্বারটা অন্তুর সবসময় মনে থাকে। কেন সেভ করে না সেটা সে নিজেও জানে না।কিন্তু সেভ করে না।

"হ্যালো, আশরাফ স্পিকিং..."
"বাপি, মম কোথায় গেছে?"
"অন্তু? নাস্তা খেয়েছ?"
"মম কোথায় বাপি?"

আশরাফ কিছু বললেন না। আসলে কি বলা দরকার সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না।বলে দেয়াটাই ভালো। নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করাটা উচিত। ছেলেটার বোঝা উচিত যে তার কোন দোষ নেই।

"বাপি, কথা বলছো না কেন? মম কোথায়?"
"তোমার মম লন্ডনে তোমার নানুর কাছে চলে গেছে।"
"ও।"
"আজ সকালে চলে গেছে।"
"ও। আমি রাখি।"
"অন্তু তোমার জানা দরকার সন্ধ্যা কেন চলে গেল..."
"বাপি প্লিজ। আমি রাখলাম।"

অন্তু কিছু অনুভব করে পারলো না তেমন। একটা ভোঁতা অনুভূতি...তেমন কোন কিছুর কথা ভাবতে ভালোও লাগছে না। মোবাইলটা বাজছে...সম্ভবত বাপি আবার ফোন দিয়েছে। অন্তু ফোনটা বন্ধ করে রাখলো।তার এই বাড়িটা অসহ্য লাগছে। বিছানা থেকে উঠলো অন্তু। তার ট্রাভেলার্স ব্যাগটা বের করলো। দু-চারটা গেঞ্জি,টি-শার্ট, জিন্সের প্যান্ট আর খাতা-কলম নিলো। টেবিল থেকে প্রিয় এস.এল.আর টা বের করলো। স্নিকার্সটা পড়লো। মানিব্যাগে যা আছে, তা দিয়ে এক মাসের খানা- খরচ হয়ে যাবে...সব টিফিনের টাকা।ও, ভালো কথা ল্যাপটপ টা খুললো অন্তু। মাকে একটা মেইল দিবে সে। দুটো লাইন লেখা মাত্র।তারপর ? হাওয়া হয়ে যাবে সে।একেবারে হাওয়া।



(এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন।লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।)

Sunday, October 17, 2010

চিরচেনা... চিরঅচেনাঃ পর্ব-১

                                               ||---------১---------||



অন্তুর মাঝে মঝে মনে হয় সকাল বেলাটা আসলে সকাল না হলেই ভালো হতো। কারণ এই একটা সময়েই বাপি-মম একজন আরেকজনের মুখ দেখেন। ঘুমের বারোটা বাজে, কিছু না খেয়েই কলেজে যেতে হয় (সামনে পড়লে ঝগড়াটা ওকে নিয়েই শুরু হয় বলে সে তাদের সামনে যাওয়াটাই আজকাল বাদ দিয়েছে) ।একটা দুটো ক্লাস করে বের হয়ে যায়,চুপচাপ কোন একটা পার্কে গিয়ে বসে থাকে।

ওইদিন রাশেদ স্যার ওকে দেখেছিলেন পার্কের ভিতর। কিছু বলেননি সেদিন। পরদিন ক্লাস শেষে জিজ্ঞেস করেছিলেন ওখানে কি করছিলো সে। "আরো দুটো ক্লাস ছিলো না তোমার?"

"জ্বি স্যার।"
"করো নি কেন?"
 কিছু বললো না অন্তু।

চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুছতে লাগলেন স্যার।"শোন, এই বয়েসটাতে একটু মন খারাপ হবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু ক্লাস করলে বন্ধুরাও তো তোমার সাথে থাকবে, ওদের সাথে তোমার কথা শেয়ার করতে পারো, তাই না?"
কিছু বললো না অন্তু। এই কলেজে ভর্তি হবার পর তার সাথে কারোই বন্ধুত্ব হয় নি। না হওয়াটাই স্বাভাবিক, সে আসলে নিজেই একটু একা থাকতে চায়।
অন্তুর কাঁধে হাত রখলেন তিনি।"আর এইরকম করো না। তোমার গার্জেনকে একটা ফোন দিতে বলবে।"
"আচ্ছা।"। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় ক্লাস শেষ হবার পর আবার বের হয়ে গেল অন্তু।

ক্লাস করতে যে ভালো লাগে না তা কিন্তু নয়; ভালোই লাগে। কিন্তু তার সে আসলে এত মানুষের মাঝে ক্লাস করতে গিয়ে কেমন যেন একটা হিংসা বোধ করে...একটা ক্ষোভ কাজ করে অন্তুর মনে। ভাবে, এত মানুষের মতো আমি হলাম না কেন? অপুর ফোন্টা কাজ করছে না, কান্তার গানের মাস্টারের সাথে ওর মন দেয়া-নেয়া চলছে, রাসেলের গিটারটার তার খুজেঁ না পাওয়া কিংবা আদনান কোন কারণে একা একা বসে কাদছে...এসবই তাকে দারুণ একটা ক্ষোভের উনুনে চড়িয়ে দেয়। সে জানে, তার এইসব সমস্যা হয় না। ফোন কাজ না করলে বাপি ফোন কিনে দেবে, মম একটা দামী গিটার কিনে দিবে না চাইতেই...আর সবচেয়ে বড় কষ্টটা হল-সে সহজে কাদঁতে পারে না।

প্রতিদিনের মতো আজও বাংলা ক্লাস শেষ হবার পর অন্তু বেরিয়ে যাচ্ছিল। আজ অবশ্য ছুটি হয়ে যেত...ফার্স্ট ইয়ারের নবীণবরণ হবে,তাই সবার আজ ছুটি । আজ কোথায় যাবে ভাবতে লাগলো সে।একবার ভাবলো একটু পুরোন ঢাকায় যাবে, তার খালার বাড়িতে বহুদিন যাওয়া হয় না। আবার ভাবলো গেমস্‌ জোনে চলে গেলেও হয়...নতুন গেমস্‌ এসেছে...।এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ...

"স্যরি...আমি দেখিনি..."
"না না, ঠিক আছে..."

ঠিক কি আছে? মেয়েটার শাড়িটা নোংরা হয়ে গেছে...মেয়েটাও মনে হচ্ছে বেশ ব্যাথা পেয়েছে।ধরে-টরে উঠালো অন্তু। মেয়েটা শাড়িটা হাল্কা ঝেড়ে দাড়ালো। অন্তু কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। চলে যাওয়াটাই ভালো, এই ভেবে গেটের দিকে রওনা দিলো।

"এই যে, শুনুন?"
 আবার কি হলো? ধুৎ, এসব ভালো লাগে না তার।
"আমাকে বলতে পারবেন  সেন্টার হলরুমটা কোন দিকে?
"বায়ে গিয়ে সোজা প্যাসেজ ধরে গেলেই হলরুমটা দেখতে পাবেন।"
"আচ্ছা, ধন্যবাদ।"

মেয়েটা হলরুম খুঁজলো কেন? ও...ফার্স্ট  ইয়ার হবে। এই জন্যই তো শাড়ি পরেছে। মম আগে যখন শাড়ি পড়ে অন্তুকে নিয়ে বাইরে যেতো, তখন তার খুব ভালো লাগতো। এখন কেন যে শাড়ি পড়ে না, কে জানে...

                                      ||----------২-----------||

রাতে শোবার আগে অন্তু একবার করে একটু তার কবিতার বইগুলো একটু পড়ে। তার কবিতা পড়তে খুব ভালো লাগে। আবৃত্তি ক্লাস করতে গিয়েছিলো কয়েকদিন, কিন্তু পরে আর যাওয়া হয়নি। বাপি অবশ্য এতে খুশিই হয়েছিলো।"মানুষ কতো রকমের কাজ করে, আর তুমি কবিতা আবৃত্তি চর্চা করছো? ভালোই হলো, এখন থেকে তুমি পারলে গিটারটা শেখার চেষ্টা কর, ওইদিন রহমানের ছেলেটা গিটার বাজিয়ে শোনালো, কি সুন্দর melody..."

আজ আর কবিতা পড়তে ভালো লাগলো না। একটু শরীরটাও খারাপ, সর্দিজ্বর-টর হবে হয়তোবা। লাইট নিভিয়ে চাদরটা মুড়ি দিইয়ে শুয়ে পড়লো অন্তু।

অবশ্য ভালো না লাগার একটা অন্য কারণও আছে। অন্তুর নিজেরও একটু বিরক্ত লাগছে। অযথা একটা মেয়েকে মনে রাখার কোন মানে আছে? আচ্ছা, স্যরি নাহয় আরেকদিন বললেই তো হবে ,তাই না? সেদিন আসার পথে শুনলো রাসেল কোন মেয়েকে আন্টি বলার কারণে ইয়া বড় এক চড় খেয়েছে। সেও যদি খায়?

হঠাৎ গাড়ির শব্দ। বারোটা বাজে, তারমানে বাপি এসেছে। মা আজ একটু আগেই এসে পড়েছিলো...এসে হড়হড় করে বমি করে ঘুমিয়ে পড়েছে।এরা যে কি কারণে ড্রিংকস্‌ করে...!
এসিটা অফ করে অন্তু ঘুমিয়ে গেল।

(চলবে)

Wednesday, October 6, 2010

...এক স্টেশন মাস্টারের গল্প।

রাত দশটা বাজে। । সকাল বেলা ভোর পাঁচটায় আন্তঃনগর আসবে। তার আগে আজ রাতে আর কোন ট্রেন নেই। চাদরটা যে কোথায় রখেছেন তা ভাবতে ভাবতেই রফিক সাহেব অনুধাবন করলেন যে তার চশমাটা কোথায় রেখেছেন তা ভুলে গেছেন।আজকাল চশমাটা না থাকলে তার বড় সমস্যা হয়।

জোলেখা বেগম বেচে থাকলে তার হয়তো এই সমস্যাটা হতো না। তিনি নিশ্চই চশমার সুতাটা বেধে দিতেন। স্বামীর কষ্ট মনে হয় এই মহিলাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করতেন। বেঁচে থাকতে যত কষ্টই হোক না কেন তার দুপুরের খাবার ষ্টেশনে পৌছে যেত। যেদিন জোলেখা মারা গেলো সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে দুপুরের খাবার খাওয়াতে পারে নাই।

ঘুমনামা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...