...............।৪।..............
অন্তু সদরঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
এই জায়গাটা একসময় খুব ভালো লাগতো। সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চ-স্টীমার, পাচঁ মিনিট পরপর বিকট শব্দ...পোঁওওওও..., আর হাজার হাজার মানুষের হাজার রকমের ব্যস্ততা।হাজার রঙ্গে বোনা এখানকার প্রতিটি মুহূর্তগুলো সদরঘাটের এই মাল্টিকালার বৈচিত্র না থাকলে এই পুরোন ঢাকার ইতিহাসটাই ঢাকা পড়ে যাবে।
অনেক গরম পড়েছে। অন্তু ইতিমধ্যে দুটো ডাব খেয়ে ফেলেছে, আরেকটা খাবে কিনা ভাবছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না তার। যাবে নাকি কোথাও? স্টীমারে যেতে অন্য রকম একটা মজা আছে, অন্তু সেটা গতবার স্টাডী ট্যুরে গিয়েই বুঝেছে। সামনের ডেকে উঠে বাতাস খাওয়া, মাঝে মাঝে দু-এক কাপ চা খাওয়া...আর আশেপাশের দৃশ্যগুলোর ছবি তো মুফ্ত ।কম খরচে অনেক মজার একটা ভ্রমন।
আজ অবশ্য মজা লাগছে না। সকালে ফোন বন্ধ করার পর সিমটাও খুলে ফেলে দিয়েছে সে। বাসার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। অন্তত কিছুদিনের জন্য সব ভুলে যেতে চায় অন্তু। এমন কোথাও যেতে চায় যেখানে তাকে কেউ অন্তত খুঁজে পাবে না।
এখানে অবশ্য আকে খুঁজে পাওয়াটা সোজা। বাপি ইচ্ছে করলেই বের করতে পারবে সে এখানে এসেছিলো কিনা। তাতে অন্তুর আপত্তি নেই। বের করতে চাইলে করুক, কোথায় যাচ্ছে, তাও জানুক, কিন্তু তাকে বাসায় ফিরে না যেতে বললেই হবে।ওটা আর তার জন্যে বাসা নয়, নরকখানা।
গেটে দিয়ে ঢুকলো অন্তু। এক টাকা ভাংতি পাবে কোথায় গেটম্যান, তাই পুরো পাঁচ টাকাই নিয়ে নিল। ভিতরে ঢুকেই বাকি টাকা গুলো পকেটে ঢুকাতে যাবে, এমন সময়...
' স্যরি...'
' স্যরি আমি...আরে ! আপনি? '
' হ্যা...কিন্তু তুমি এখানে...কি করে...'
'আমি আজকে বাসায় যাব।আমার বাড়ি চাঁদপুর ।'
' ও।'
' কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? '
' আমি? আমি...' কি বলবে অন্তু? বিস্ময়ের ধাক্কাটাই কাটছে না এখন পর্যন্ত। এই মেয়েটার সাথে তার দেখা হলো মাত্র দুই দিন, কিন্তু এই দুই দিনই একেবারে বাস-ট্রাক সংঘর্ষ ! এখনো বুঝতে পারছে না অন্তু কি বলবে।'...আমি এমনিতেই এসেছি...তেমন কোন কারণ নেই...'
' অ। আমি ভাবলাম কোথাও যাবেন হয়তো...' ব্যাগটা টানতে টানতে বললো।ভারী মনে হচ্ছে ব্যাগটা। একটু হেল্প করবে নাকি...? না,থাক। পর মুহূর্তেই আবার...
' আমি ব্যাগটা ধরবো? '
' না না, আমি পারবো।'
' অ।' একটু হাঁপ ছেড়েই বাচলো অন্তু । ব্যাগ টানার কথা বলেই নিজে একটু লজ্জাই পেল। এটা কেন বলতে গেল? ওতো নিজেরটা নিজেই টানতে পারছে, তাই না?
লঞ্চ ঘাটে এসে পড়েছে। এই লঞ্চেই যাবে মেয়েটা?
' আমি তাহলে আসি। '
'আচ্ছা, আবার দেখা হবে।'
'তাতো হবেই, কলেজে তো যাবেন, তাইনা?'
'হ্যা, হবে নিশ্চয়ই। বাই...।'
' বাই।' বলে কেন যেন আনমনেই হাসলো মেয়েটা। অন্তু খেয়াল করলো না। কিছুক্ষন পর অন্তুও হেসে উঠলো। কেন হাসলো দুজনের কেউ কি জানে?
............।৫।............
লঞ্চের টিকিট কাউন্টারের বসে থাকা মৌলভী মতন লোকটা অনিমাকে চেনে। প্রথমবার আসার সময় বাবা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো।'এটা ভাই আমার মেয়ে, ঢাকায় পড়াশোনা করে। আপনাদের এই লঞ্চেই আসা যাওয়া করবে। আসা যাওয়ার পথে একটু খেয়াল রাইবেন।'
বিগলিত একটা হাসি দিয়ে লোকটা বলেছিলো, 'চিন্তা করবেন না ভাই সাহেব। আপনার মেয়ে তো আমাদের মেয়ের মতোই। কোন সমস্যা নাই, আমি খেয়াল রাখবো।এক ফোঁটা আচঁড় ও লাগবে না"।এরপর থেকে এই লঞ্চে উঠলে এই লোকটা ক্রমাগত বিরক্ত করে। কারণে-অকারণে এসে কেবিনে বসে। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয় ।''মা তোমার কি লাগবে বলো, আমি তোমাকে এনে দেব।'
'আমার কিছু লাগবে না চাচা।'
'লাগবে লাগবে। এই দুনিয়ায় মেয়ে মাইনষের সবচেয়ে বেশি জিনিষপাতি লাগে। আওরতের চাহিদা ছিলো বইলাই তো আমরা দুনিয়ায়, তাইনাগো মা জননী...?'
'এখন কিছু লাগবে না, লাগলে আমি আপনাকে বলে আসবো।'
'আইসো, আইসো।চিন-পরিচিতের মধ্যে কেউ না থাকলে আর কারো কাছে কইয়ো না মা। লঞ্চের মানুষগুলা ভালো না। এরা গন্ধে গন্ধে আসে, গন্ধ শুইকা চইলা যায়। কারো লগে মিশবা না মা্, আমি তো আছিই...'
আজকেও ঠিক একই রকম অবস্থা। দেখেই যেই একটা হাসি দিলো, তাতে পারলে যেন বত্রিশ দাঁতের সবগুলো বের হয়ে আসবে। পানের পিক ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। 'কেমন আছো মা, ভালো...?'
'হুম। একটা টিকিট দিন, কেবিনের দিবেন।'
'কেবিনের টিকিট তো নাই।'
'নাই?'
'না মা, আজকে লঞ্চ পুরাই ভর্তি।পাবলিক এক ঈদ বাদে এমন ভীড় করে না। আজকে মানুষের কোন গোনা-গুণতি নাই, সব উইঠা পড়ছে।'
কি করবে এখন অনিমা? যাওয়াটা খুব দরকার, মার অসুখ আবার বেড়েছে। বাবাকে কালকে খুব বিষণ্ন শোনাচ্ছিলো।"তোর মার অপারেশন করানোটা খুব জরুরীরে অনি..."
'কেন আব্বা, আর কয়েকদিন পরে করানো যায় না? মিন্টু চাচা কি বললো?'
'কি আর বলবে, বললো এবার চিকিৎসা না করতে পারলে তোর মা হয়তো...'
'ও। বাবা,একটা কথা বলি?'
'বল।'
'উত্তর পাড়ার জায়গাটা বেঁচে দিলে হয়না ?'
'ওটাতো কবেই...। '
লাইনটা কেটে গিয়েছিলো। সম্ভবত মোবাইলে টাকা নেই।অনিমা আর কিছু না বলে আজকে বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিল। আর আজকেই কিনা ঢাকা শহরের সব মানুষকে এই লঞ্চে উঠতে হবে?
'একটা কেবিন কোনভাবে ম্যানেজ করা যায় না ?'
'ম্যানেজ...হ্যা' আবার একটা হাসি দিলো আইজুদ্দিন।'আছে, একটা আছে ঠিকই।'
আছে? কোনটা চাচা? কত লাগবে ?
'ইয়া আল্লাহ, মেয়েটা বলে কি?'জিহবায় কামড় লাগায় সে। 'তোমার জন্যে টাকা লাগবে কেন? তুমি এমনিতেই যেতে পারবা...পুরাই ফ্রি !'
'মানে?'
'মানে আবার কি? আমার একখান রুম আছে না...?ওইখানে থাকলেই হবে, কোন সমস্যা হবে না...'
আবার শুরু হয়ে গেলো। 'না চাচা।অনেক ধন্যবাদ, আমার লাগবে না।'
'আহা, এমন কর কেন...রাগ করলে চলে ? কোন সমস্যা হবে না, তুমি আমার রুমে থাকবা...।'
'না। আমি কোন একটা ব্যাবস্থা করে নিতে পারব,' বলে দ্রুতপায়ে সেখান থেকে চলে গেলো। লোকটাকে দেখতেই তার এখন অসহ্য লাগছে।
দোতলায় চলে গেলো অনিমা। এখানে সবাই নিচে পাটি- চাদর পেতে বসে। তার এলাকাটা ছোট, খুব সহজেই পরিচিত কাউকে পেয়ে যাবে।ওইতো যুঁথি আপারাই তো ওখানে বসে আছে।অনিমা তাড়াতাড়ি ওদের ওখানে চলে গেল।
'আপা কেমন আছেন?'
'আরে অনিমা যে? কেমন আছিস?'
'এইতো আপা। বাড়ি যাচ্ছো ? '
'নারে...বাড়ি এবার উঠবো না, শ্বশুড় বাড়ি উঠবো। আমার ছোট ননদের বিয়ে, তাই ছুটি নিয়ে যাচ্ছি।এইযে দেখছিস না রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে? এ হচ্ছে আমার বড় ভাসুর। ডাক্তার মানুষ, চর্মরোগের ডাক্তার। ঢাকায় চারটা বাড়ি। পাশে যে দেখছিস হ্যাংলা করে ছেলেটা, ওটা আমার বরের চাচাত ভাই।আজকাল কিসব গান গায়, কিচ্ছু বুঝি না ছাই!...'
কান ঝালাপালা হয়ে গেল অনিমার।পুরো রেলিং জুড়েই খালি এতো আত্মীয়!। না বসাই তো ভালো ছিলো !
"তারপর দেখছিস না ওই ছেলেটা ওটা হচ্ছে...আরে? এটা না, এটা কেউ না।তারপর যে আছে..."
কিন্তু যে যুথি আপার কেউ না, তার দিকেই চোখ আটকালো অনিমার।
এই ছেলেটা লঞ্চে কেন?
(চলবে)
(এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন।লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
ঘুমনামা
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...
-
Biodiesel is usually made by combining methanol and lye with vegetable oil, animal fat, or recycled cooking grease. It can be bl...
-
ছবি দুইটি সাধারণ কোন মানুষের আঁকা ছবি বলে ভাবছেন? হতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু ছবি দুটো আঁকা শিল্পী LSD খেয়ে ছবিগুলো এঁকেছেন!!! LSD (...
No comments:
Post a Comment