Wednesday, October 6, 2010

...এক স্টেশন মাস্টারের গল্প।

রাত দশটা বাজে। । সকাল বেলা ভোর পাঁচটায় আন্তঃনগর আসবে। তার আগে আজ রাতে আর কোন ট্রেন নেই। চাদরটা যে কোথায় রখেছেন তা ভাবতে ভাবতেই রফিক সাহেব অনুধাবন করলেন যে তার চশমাটা কোথায় রেখেছেন তা ভুলে গেছেন।আজকাল চশমাটা না থাকলে তার বড় সমস্যা হয়।

জোলেখা বেগম বেচে থাকলে তার হয়তো এই সমস্যাটা হতো না। তিনি নিশ্চই চশমার সুতাটা বেধে দিতেন। স্বামীর কষ্ট মনে হয় এই মহিলাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করতেন। বেঁচে থাকতে যত কষ্টই হোক না কেন তার দুপুরের খাবার ষ্টেশনে পৌছে যেত। যেদিন জোলেখা মারা গেলো সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে দুপুরের খাবার খাওয়াতে পারে নাই।


বড্ড শীত পড়েছে। আজকাল শীত পড়ে না বললেই চলে। যেটুকু পড়ে সেটুকুও সহ্য করার মতোই। কিন্তু এইবার বেশ ভালোই উত্তরের বাতাস বইছে। রফিক সাহেব জানালাটা বন্ধ করে দিতে চেয়ার থেকে উঠলেন।হাঁতড়ে হাঁতড়ে যখন তিনি জানালার কাছে পৌছুলেন, তখন তিনি দুবার হোচট খেয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

কোথায় চশমাটা? তাকের উপরে? শেলফের উপরে কি? সন্ধ্যায় যখন বের হয়েছিলেন তখন তো হাতেই ছিলো। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তো চশমাটা চোখে দিয়ে দু-চার লাইন খবর পড়লেন।এরপর যে কোথায় রাখলেন...

চেয়ারের কাছে আসতেই  চেয়ারের উপর ভাজ করা চাদরটা পেলেন। এলাকার জব্বার চেয়ারম্যানের দেয়া এটা। বড় আরামদায়ক। এতোদিন অবশ্য কোন কাজে আসেনি, কিন্তু এবারকার শীতে ভালোই কাজে দিচ্ছে।

স্টেশন মাস্টার রুম থেকে আস্তে আস্তে বের হলেন রফিকুল সাহেব। ছাব্বিশ বছর ধরে চাকুরী করেন তিনি। এই ছাব্বিশ বছরের চাকুরী জীবনে এই স্টেশনের কোন পরিবর্তন হয়নি। যেমনটা ছিল, ঠিক তাই আছে। কাজেই আসতে তেমন একটা পরিশ্রম হলো না।সামনের বেঞ্চটা পার হলেই ওয়েটিং রুম। রফিক সাহেব দেয়াল ধরে ধরে ওয়েটিং রুমটাতে গেলেন।

লাইটটা নেভানো কেন? ফিউজ হয়ে গেলো নাকি?  "রাজ্জাককে কতবার বললাম ছেলেপিলেকে এখানে ঢুকতে দিস না, এখন হলো তো !" রাগে গজরাতে গজরাতে দরজা বন্ধ করতে লাগলেন তিনি।

"এসেছো?"

চমকে উঠলেন রফিক সাহেব। এই ডাক তার বহু দিনের চেনা !কাঁপতে লাগলেন তিনি। " কে? "

"আমি।চিনতে পারছনা?"

কুল কুল করে ঘামতে লাগলেন তিনি। জীবনে এই প্রথম চমক জিনিষটা কিরকম হতে পারে সেটা অনুধাবন করলেন।যার কথা কিছুক্ষণ আগে ভাবছিলেন, সে কিনা... না না, এ কি করে সম্ভব?

"এত অবাক হচ্ছ কেন? তুমি তো কোনদিন অবাক হতে না।"

কথাটা পুরোপুরি সত্যি।মানুষের এই গুণটা জন্মাবার সময় আল্লাহ তাকে দেননি। মানুষ কত কিছু দেখে চমকায়, কত কিছু দেখে ভড়কায়, কিন্তু তার এই অনুভূতিটা ছিলো পুরোপুরি অনুপস্থিত। মন্টু যখন মারা যাচ্ছিল তখন কেনো যেন তার কোন কষ্ট হয়নি। জোলেখা চিৎকার করে কাঁদছিল। তিনি নির্বাক চোখে মন্টুর দিকে তাকিয়ে ছি্লেন। মন্টু খালি একবার বলেছিলো "বাবা..."।তিনি মন্টুর রক্তমাখা হাত ধরে বসে থাকলেন। পরদিন যখন মন্টুর দলের লোকজন এসে তাকে সান্তনা দিতে লাগলো,তিনি বিরক্ত হয়ে স্টেশনে চলে এলেন, ঘরে থাকার আর কোন মানে খুজে পেলেন না।

"মন্টুর কথা ভাবছো,তাই না?"
"হু।তুমি কিভাবে...?"
"আমার জানতে হয়। সব জানতে হয়। তোমার কথা জানতে হয়, রোশনির কথা জানতে হয়...।তোমাদের কথা না ভেবে কি আমার একটা দিন কখনো কেটেছে...?"

সে কথা এখন অনুধাবন করেন রফিক সাহেব। চাকুরীর বাইরে তার কোন খোজ-খবর তেমন একটা ছিল না। বাসার সব দায়িত্ব ছিল জোলেখার। ষোল বছর বয়েস থেকে শুরু করে শেষ অবধি তো আর কম করেনি !

সেকি, জোলেখাকে এমন লাগছে কেন? একেবারে ঠিক সতেরো বছর বয়েসের কিশোরী। রফিক সাহেবের মনে আছে, জোলেখা যখন ঘরে আনেন ,তখন ওর চুল ছিল কবরীর মতো।চোখগুলো টানাটানা, আর দেহপল্লব যেন যৌবনের অপুর্ব রাজ্য।ঠিক সেই পাগল করা জোলেখা আজ আবার সামনে? এ কি করে হয়?

"কি হলো ? তুমি অমন হাঁ করে আছ কেন?"
"এমনি...কিন্তু...?"
"আবার কিন্তু কি?"
"না, কিছু না। তুমি কেমন আছ জোলেখা?"
"আমি? আমি তো ভালোই আছি । তুমি কেমন আছো?"

জবাব দিতে পারলেন না তিনি। অবশ্য তিনি অধিকাংশ প্রশ্নের-ই জবাব দিতে পারেন না। ছোটবেলায় কেউ যখন তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করতেন, বেশিরভাগ সময় তিনি নির্বাক থাকতে পছন্দ করতেন। তার কথা বলাটা খুব একটা পছন্দের না। স্টেশনে তার এতো মানুষের ভীড়েও কথা বলাটা খুব একটা ভালো লাগে না। জোলেখা বাসায় থাকলে হাজার রকমের প্রশ্ন করতো। আজ সারাদিন কি হলো, কয়টা ট্রেন গেলো, কত লোকের ভীড় ছিল...সব যেন তার জানা চাই-ই চাই। মাঝে মাঝে ডিউটি না থাকলেও ঘরে আসতে তার মন চাইতো না। চুপচাপ স্টশনে বসে থাকতেন।

"বলবে না,তাই না? আমি অবশ্য জানি তুমি কেমন আছো। ঐ যে, বললাম না তোমাদের কথা আমার জানতে হয় ?"
"হু...। জোলেখা, আমি এখনো বুঝতে পারলাম না তুমি...?"
"আমি কিভাবে আসলাম? আমি তো এখন মুক্ত, সব কিছু থেকেই মুক্ত ।" এক  মুহূর্ত চুপ থাকলেন জোলেখা।" রোশনির খবর নাও তুমি?"

অনেক দিন আগে খোঁজ নিয়েছিলেন রফিক সাহেব। কি হবে মেয়ের হাড্ডিসার শরীর দেখে? ডাক্তার যখন বললেন ওর বাঁচার আর আশা নেই, তখন কেন যেন রোশনির প্রতি তার মায়াটা চলে গেল। তার বড্ড ন্যাওটা ছিলো মেয়েটা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরতো। স্কুলে যাবার সময় খাবারটা নিজে দিয়ে আসতো। খুব মেধাবী ছিল রোশনি। ম্যাট্রিকে বোর্ড স্ট্যান্ড করা মেয়েটা যখন কলেজে পড়তে যেতে পারলো না তখন কি তার কোন কষ্ট হয় নি? হয়েছিল হয়তোবা। ক্যান্সার হাসপাতালে রেখে আসার সময় মেয়েটা তাকে ছাড়তেই চাচ্ছিল না, বারে বার জড়িয়ে রাখছিল। কে জানে, এখন কেমন আছে রোশনি।

"তোমার দুই ছেলে মেয়েই এখন আমার কাছে আছে। দেখবে ওদের? "

তার বুকটা হাহাকার করে উঠলো। কতদিন, কতদিন পর মনে হলো তার পরিবারের কথা...পরিবার, উহ্‌ ! কতদিন দেখেন না তার মন্টুকে, কতদিন কলপারে ওযূ করার সময় মন্টুর আযান শোনেন নি তিনি, কত সুন্দর আযান দিতো ছেলেটা। কতদিন রোশনিকে আরবি পড়ান নি তিনি, কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে... কত স্মৃতি...!

"দেখতে ইচ্ছে করছে তোমার? আমরা সবাই আছি...সবাই। আমরা একসাথে থাকবো...তুমি, আমি, মন্টু আর রোশনি...?যাবে রফিক? যাবে আমার সাথে ?"

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন রফিকুল ইসলাম...। কুয়াশার মাঝে হাঁটা শুরু করলেন। সাথে জোলেখা। কত কথা মনে পড়তে লাগল...অনেক কথা। হাটতে হাটতে আলো দেখতে লাগলেন তিনি। সেই অজানা আলোর দিকে জোলেখা যাচ্ছে..."জোলেখা...,নিয়ে যাও আমাকে...আমি যাবো তোমার সাথে, জোলেখা...!"




                                             ------||পরিশিষ্ট||------


রফিক সাহেবের কাটা লাশটা  দেখে হাসানের ভালো লাগলো না। স্টেশনে থাকতেই ভালো লাগলো না ওর। রিপোর্টে কি লিখবে? কার জন্য এই রিপোর্টটা লিখবে সে? লোকটার কোন আত্মীয় নেই, কোন পরিচিত কেউ নেই। কেন আত্মহত্যা করছে কেউ জানে না। অপঘাতে মামলাটা করে রাখবে? মাথাটা কাজ করলো না তার, গরম হয়ে গেলো। "করিম! চা নিয়ে আয়তো !"

হঠাৎ লাশের শালটার দিকে চোখ পড়লো তার। সুন্দর শাল, অনেক দাম হবে। হাসান পরিষ্কার করে গায়ে দিল। ভালোই লাগছে তার। আর যাই হোক, রফিক সাহেবের পছন্দটা ভালোই ছিলো!

ঘুমনামা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...