Thursday, November 29, 2012

রজব আলীর ইতিবৃত্ত



রজব আলীর পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। দীর্ঘ কাঁচাপাকা চুলের বয়স কত, তাও এখনো আমাদের কাছে একটা রহস্য। হুদা লেনের একপাশে রজব জুতো পালিশের জন্য বসে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কাঠের পিড়িতে সারাদিন বসে থেকে সে শুধু জুতো পরিস্কার করে, নাকি আর কিছু ভাবে, সেটা দেখার সময় পাড়ার নেড়ি কুকুরটা ছাড়া আর কারো আছে বলে মনে হয় না। হুদা লেনের লোকজন কেবল জানে, রজব আলী নামে একজন মুচি আছে, যাকে একপাটি ছেড়া ময়লা ছাল ওঠা জুতো দিলেও তা চমৎকারভাবে সারিয়ে তুলবে।



তার বসার জায়গাটার পাশেই অত্র এলাকার বিখ্যাত স্কুল। দেশ বিভাগের সময় কোন এক জমিদার তার বাড়িটি ফেলে কোলকাতায় চলে যাবার পর থেকে এখানে স্কুল চালু হয়। আশেপাশের এলাকার ছেলেপিলেরাও এখানে পড়তে আসে। ফল তেমন খারাপ না, তবে এখান থেকে এককালে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীরা এখন সরকারী চাকরি করছে বলে এখানকার শিক্ষকরা বেশ প্রচার করে।

রজব আলীর এই স্কুলের সামনে বসার একটা ইতিহাস শুনতে পাই এই এলাকায় আমার পরিচিত এলাকার একমাত্র বয়স্ক রিকশাওয়ালা ছগির মিয়ার কাছ থেকে। একদিন তার রিকশায় যেতে যেতে দীর্ঘ আধা ঘন্টা ধরে আমি এই ইতিহাসের বয়ান শুনি।

রজব আলী এককালে এলাকার চৌকিদার হুসেন আলীর পুত্র ছিল। সে এবং তার পিতা-দুজনে হুদা লেনের শেষ মাথার ঝিলপাড় মসজিদে রাত কাটাতো, সকালে রজব স্কুলে আসত পড়তে। স্কুলে তার কাজ ছিল ঘন্টা বাজানো। সময় হলেই রজব ঘন্টা বাজাত, ছুটির ঘন্টা। মাঝে মাঝে হেডস্যার তাকে দিয়ে অন্য ফাই-ফরমাশও খাটাত। বিনিময়ে বিনে পয়সায় পড়াশোনা করার একটা গতি হয়ে যেত রজব আলীর।

তার বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিল না। নীচু জাতের বিমল নামের এক মেথরপুত্রের সাথে তার হালকা সখ্যতা ছিল। দুজনে মিলে বিকেলে স্কুলের উঠোন পরিস্কার করে ঝিলপাড়ে বসে আড্ডা দিত, কিংবা ঘুড়ি ওড়াত। তাদের এই বন্ধুতা বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায়না, কারণ বছর দুয়েক সখ্যতার পর টাইফয়েডে বিমল মারা যায়। এরপর রজব আলীর আর কোন বন্ধু হয়নি। 

ঘটনাটা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার, ছগির মিয়ার কথা অনুযায়ী তখন মিলিটারীরা মাত্র এলাকায় ঢুকেছে, বাজার এলাকা আগুনে পুড়ে ছারখার, পাড়ার তিন-চারটে পরিবারের লাশ ঝিলপাড়ে পড়ে আছে। পুরো এলাকা থমথমে। দু-চারদিনের মধ্যেই মিলিটারীরা স্কুলে ক্যাম্প করে ফেলল। এলাকার দু-তিনজন মাতবর গোছের মানুষজন উৎসাহী হয়ে শান্তি বাহিনী করে লুটপাট করতে লাগল। তাদের বাসায় অফিসারদের নিয়মিত আড্ডা বসতে লাগল, তাতে ধরে আনা মেয়েদের নিয়ে নাচ-গানের নামে নির্যাতন হতে লাগল।

রজব আলী তার বাবা মারা যাবার পর স্কুলের পিয়নের কাজ নেবার সাথে সাথে যে বাড়িটায় কাজ নেয়, সেই বাড়িটা ছিল এরকম একটা বাড়ি। সালাউদ্দিন মাতব্বরের বাড়ি। প্রত্যেক মঙ্গলবার রাতে অফিসারদের ব্রিফিং শেষ হলে অফিসাররা এই বাড়িটাতে এসে আসর জমাতেন। সালাউদ্দিন নিজে তাদের সাথে বসে আড্ডা দিত। তার মেয়েদের সাথে অফিসারদের পরিচয় করিয়ে দিত, একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিত। গভীর রাত পর্যন্ত বাড়িটাতে উর্দু গজলের সুর শোনা যেত দূরের রেলস্টেশন পর্যন্ত।

রজব আলী এইসব অফিসারদের কান্ডকারখানা অবাক হয়ে দেখত। উর্দুর আবোল-তাবোল ছোটবেলা থেকেই সে বুঝত না, একই লাইনে  পেয়ারার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক কি করে হলো সেটা তাকে বুঝাতে মাস্টারমশাইয়ের বুঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। একে তো কোথাকার কোন যাত্রাপালার গায়ক একখানা ধরে এনে বিচ্ছিরি সুরে উর্দূ গান গাওয়ানো হচ্ছে, আর সেই গানের তালে তালে মাতাল অফিসারগুলো দুলে দুলে ঝিমুচ্ছে। হঠাৎ করে অট্টহাসিতে ঘর কাপিয়ে দিচ্ছে, আবার রাগের মাথায় চেচিয়ে উঠছে...। ব্যটাদের কান্ডকারখানা দেখে আসলে ওর অ্যাসপিরিন গেলার মতন গা গুলিয়ে উঠলো। এদিকে সালাউদ্দিনও কম খাটাচ্ছে না, হারামজাদাটা খাটিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। এত্তগুলা মানুষের এটা-সেটার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে তাকে।

সালাউদ্দিনের বাসাকে এখন জিনিষপত্রের গুদাম বলা যায়। এলাকার সব দোকানে লুটপাট শেষ তার। যেই কলিম কাকাকে সেলাম না দিয়ে জীবনেও সালাউদ্দিন বাজারে যেত না, গত শুক্রবার কলিম কাকার দোকানে ঢুকে কাকার লাশের উপর দিয়ে গিয়ে সগুলো চালের বস্তা নিয়ে আসল, একটাও রাখল না। এরকম লুটের মাল দিয়ে সালাউদ্দিনের 'মেহমান' দের আপ্যায়ন করাতে হচ্ছে রজব আলীকে। সালাউদ্দিনের অসুস্থ বউটারও রেহাই নেই, বসে বসে রান্না করতে করতে তার জীবনটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে।

রজবের এসব ভালো লাগে না। সে পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু যায় নি কার কাছে যাবে সেটা জানে না বলে। এলাকার অধিকাংশ পরিচিতজনেদের পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুলের দারোয়ানকে একদিন পাওয়া গেল স্কুলগেটের সামনে, চিৎ হয়ে মরে পড়ে আছে। এলাকার তিন চারটা বাড়ির সামনে গেলেই মরা লাশের গন্ধের চোটেই দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। কারো সাথে পালিয়ে গ্রামে যাবে? যেতে পারত, কিন্তু গ্রামের নাম-ধাম যে কিছুই তার মনে নাই। বাস থেকে নেমে পাট ক্ষেতের সামনে দিয়ে একশ কদম হাটার পর ছিল তাদের বাড়ি- এইটুকুন স্মৃতি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া সম্ভব?   

সালাউদ্দিনের বাসায় তার প্রধান কাজ ছিল এখানে আসা অফিসারদের জুতো পালিশ করা। সে একমনে জুতোগুলো পালিশ করত, যতক্ষণ পর্যন্ত না জুতো চকচক না করে। জুতোগুলো ছিড়ে গেলে সেগুলো সেলাই করতে হত। পুরো কাজ তাকে মন দিয়ে করতে হতো, কারণ কাজ না করলে সালাউদ্দিন তাকে খেতে দিত না, দুই-চার বার বুটের বাড়ি খেতে হত। ১৫-২০ জোড়া জুতো পরিস্কার করার পর সেদিনের রাতের খাবার তাকে দেয়া হত। ফুলে যাওয়া হাতের কবজি নিয়ে রজব ঘুমাতে যেত।

একদিন তার এই জুতো পরিস্কার করার কথা কোন এক মেজরের কানে যায়। তিনি সালাউদ্দিনের বাসায় বৈকালিক নাস্তা সেরে রজব আলীকে তার সামনে নিয়ে আসতে বলেন। সালাউদ্দিন রজবকে নিয়ে মেজরের কাছে যায়। যাবার সময় রজবকে সতর্ক থাকতে বলে সালাউদ্দিন,''সাবধানে কথা কবি। অল্প কথা বলবি, মেজর সাহেবের মনে কি আছে আল্লাহ মালুম!''

মেজর রেহমান রজবকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে চুপ মেরে বসে থাকে, কোন কথা বলে না। রজব আলী ভীত চোখে তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে । সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে রেহমান রজবকে যা বলল তা ছিলো এরকম, ''তুমি খুব ভালো জুতো পরিস্কার করো। তোমাদের এই কর্দমাক্ত এলাকায় আমাদের জুতোর যা অবস্থা হয়, তা বলার বাইরে। তুমি না পরিস্কার করলে প্রতিদিন সকালে উঠে আমাদের এই রাবিশ পরিস্কার করতে অনেক কষ্ট করতে হত।''

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে রেহমান আবার বলল,''তুমি আমাদের ক্যাম্পের গেটের সামনে যে গ্রোসারি শপ (মুদি দোকান) আছে, তার পাশে বসবে। আমাদের সোলজারদের জুতো পালিশ করবে। আমরা ফিটফাট আর্মি নিয়ে এসেছি, টিপটপ আর্মি নিয়েই এখান থেকে যাব।'' একটু থেমে সালাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবে হেসে বলল,'' তোমাদেরকেও টিপটপ বানিয়ে যাব।"

এরপর থেকে রজব আলীর জায়গা হয় স্কুলের সামনে মতি মিয়ার পুড়িয়ে দেয়া দোকানের সামনে। সেখানে সৈন্যরা এসে তাদের বিশাল পা ফেলত মতি মিয়ার সামনে। রজব আলী বুরুশে কালি মেখে আশ্চর্য দক্ষতায় জুতো পালিশ করত। মুচির কাজ না শিখেও তার কাজে সে নিজেই অবাক হত, যদিও তখনকার পারিপার্শ্বিকতা তার অবাক হওয়ার ক্ষমতাকে দিনদিন ভোঁতা করে দিচ্ছিল।

যুদ্ধ তখন সেপ্টেম্বর গড়িয়ে নভেম্বরে। আস্তে আস্তে এলাকায় প্রতিরোধ বাড়ছে, সীমান্ত থেকে ছেলেরা এই এলাকায় এসে খন্ডখন্ড যুদ্ধ করছে। মাঝে মাঝে দুই একজন 'মুক্তি' কে পাকসেনারা ধরে আনছে, দুই-তিনদিন ধরে ক্যাম্পের ভেতরে তাদের নির্যাতনের চিৎকার রজব আলী শুনতে পেত। এরপর একদিন এদেরকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হত ঝিলপাড়ে। মেরে ফেলে রেখে আবার সৈন্যরা ক্যাম্পে ফিরে আসত। কোন এক দিনের ঘটনা-এক সৈন্য এরকম এক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ঝিলপাড়ে মেরে ফেলে আসার পর হাসিমুখে রজব আলীর সামনে বুটটা ধরে বলে, ''এই বুটটা নষ্ট হয়ে গেছে, সা'ফ কর দো।" 

রজব বুটজোড়া হাতে নিয়ে চমকে যায়। একপাটিতে তাজা থকথকে রক্ত পুডিংয়ের মতন লেগে আছে। রজব আলী রক্তমাখা বুটটা সেদিন কত জোরে পালিশ করেছিল সেদিন জানে না। তবে সেদিন লোকটা খুশি হয়ে তাকে ২ টাকার একটা চকচকে নোট তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। টাকা নেবার সময় চোখের কোন বেয়ে যে অশ্রু পড়েছিল, সেটা আসলে বেদনার না ঘৃণার, সেটা বোঝা দায়।

নভেম্বরের দশ তারিখ রাতের বেলা তার জিনিষপাতি গুছিয়ে রজব আলী ক্যাম্পের সামনে থেকে চলে যাবার সময় দুজন লোক তাকে জাপটে ধরে। তাকে চোখ বেধে প্রায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হয় গোপন কোন জায়গায়। প্রায় আধা ঘন্টা পর তার চোখ খুলে দিলে সে দেখতে পায় কোন এক টিনশেড গ্যারেজের পেছনে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। সামনে তিন চারজন তার বয়েসী ছেলে মাটিতে বসে আছে, হাতে সিগারেট। ভাঙ্গাচোরা গাড়িগুলো এলোমেলো করে রাখা, দুই একটা গাড়ির মধ্যে কিছু ঢেকে রাখা। রেডিওতে গান বাজছে, সবাই অলস ভঙ্গিতে গান শুনছে। রজব আলীর দিকে দুই একজন তাকাচ্ছে বটে, কিন্তু চোখে দেখেও না দেখার মতন।

চোখের বাধন খুলে দেয়া ছেলেটা তাকে চুপ করে বসতে বলে। কিছুক্ষণ পর মধ্যবয়সী একটা লোক এসে বলে,''রজব আলী আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি তোমার অঙ্ক শিক্ষক।''

রজব চিনতে পারে। তার অঙ্ক শিক্ষককে সে হাসিমুখে সালাম করে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর তার শিক্ষক রজব আলীকে বলেন, ''তোমাকে ওইদিন রেকি করার সময় ক্যাম্পের সামনে দেখে অবাক হই। আমি জানতাম তুমি তোমার বাবা মারা যাবার পর এই হুদা লেন ছেড়ে চলে গেছ। তোমাকে জানোয়ারগুলোর জুতো পরিস্কার করতে দেখব বলে আশা করি নাই।''

একটু থেমে তিনি রজব আলীকে এখানে ধরে নিয়ে আসার কারণটা ব্যাখ্যা করেন। ''আগামীকাল রাতে স্কুলের ক্যাম্পে গোলাগুলি হবে। আমাদের অনেক সাহায্য দরকার। আমি যদি বলি, রজব, আমাকে তুমি একটু সাহায্য কর, তুমি কি সাহায্য করবে?''

রজব আলী তার শিক্ষকের জন্য সে কিছু করতে পারবে সেটা তার জন্য বড়ই আনন্দের বিষয়। সে সানন্দে রাজি হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ক্যাম্পের ব্যাপারে সে যতটুকু জানে সবটা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। মুক্তিসেনারা সেগুলোকে বারবার করে আয়ত্ত করে, তাদের পরিকল্পনা সাজায়। 

যাবার আগে তাকে কিছু গুলিভর্তি ম্যগাজিন দিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ''কালকে আমাদের একটা ছেলে এসে তোমার কাছ থেকে এগুলো নিয়ে যাবে। তার কাছে এগুলো দিয়ে দেবে। ব্যাপারটা গোপন, কারো কাছে এগুলো নিয়ে কথা বলবে না।''

রজবকে চোখ বেধেই নিয়ে যাওয়া হয় সালাউদ্দিনের বাড়ি থেকে একটু দূরে। সেখান থেকে সে সালাউদ্দিনের বাড়িতে যায়, গোলাবারুদসহ ম্যগাজিন তার কালির বাক্সে আসার আগেই লুকিয়ে রাখে। তার মনে হালকা ভয়,উত্তেজনা কাজ করলেও তেমন ভারী কোন অনুভূতি কাজ করে না।

রাতে বাড়িতে সবাই ঘুমে ছিল, খালি সালাউদ্দিনের বউ ঘুমায় নি। রজব আসতেই সে রজবের জন্য ভাত বেড়ে দেয়। রজব ভয়ে ছিল, তার দেরি হবার কারণ নিয়ে মহিলা যদি প্রশ্ন করে?
 

কিন্তু রজবের বউ কিছু বলল না। রজবের খাওয়া শেষ হতেই রজবের কাছে এসে পাঁচটা টাকা দিল। 'সাজুদের বাসায় যেতে পারবি একবার?' রজব চুপচাপ খেতে থাকে। মহিলার বোনপোকে সালাউদ্দিনের লোকজন ধরে নিয়ে গেছে, সেটা মহিলা জানে না। 

'দেখে আসতে পারবি বাপ? ওর বঊটাকে এই টাকাটা দিয়ে আসিস, আর সাজুকে বলিস আমার বাসায় যেন একবার আসে'। বলতে বলতে রজবের বউয়ের গলাটা ভারী হয়ে আসে।

রজব খাওয়া শেষ করে। তারপর টাকাটা নিয়ে যায়। হাজার হোক, মহিলাকে বোনপোর মৃত্যুর খবর শোনালে মহিলা যদি সালাউদ্দিনের সাথে গোল বাধায়? তাহলে খাবার দিবে কে তাকে?
 

পরদিন সকালে সে মতিমিয়ার দোকানের সামনে বসে। সারাদিন অলস সময় কাটে, গত রাতের কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে চিন্তিত হয়। বাক্সে গুলিভরা ম্যাগাজিনগুলো এখনো আছে। সেপাইদের সামনে বাক্স খুলে দেখাটা ঠিক না। সে দেখেও নাই। তবু মাঝেমাঝে কৌতুহলে তার বাক্সের দিকে তাকায়। চেনা বাক্স আজ অচেনা রহস্যের খোরাক হয়ে দাঁড়ায়।

বিকেল পর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটল না। দুইজন বয়স্ক মানুষ তার কাছে এসে দুইটা বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। সৈন্যদের কেউ আজ তার কাছে জুতো সেলাই করতে আসল না। আজকে টহল তেমন একটা দেখা গেল না। পুরো ক্যাম্প ঝিমুচ্ছে বলে মনে হল।

তখন সন্ধ্যা নামে নামে প্রায়। রজব এই সময়টায় এখানে থাকে না, তবে বাসায়ও ফিরে যায় না। সে হুদা লেনের বাসাগুলোর চেহারা দ্যাখে যায় একবার করে, সেগুলোর সুস্থ সবল চেহারাগুলো ধর্ষিত, মৃতপ্রায়। মসজিদের ভেতর গিয়ে মাগরিবের নামাজটা পড়ে, যদিও খাঁ খাঁ করা মসজিদের ভেতর ঢুকলে ভীষণ ভয় করে তার। আস্তে আস্তে মিশকাল অন্ধকার যখন শিমুল গাছটাকে ঢেকে ফেলে, তখন সে চলে যায়।


কিন্তু আজকে তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তার শিক্ষক বলে দিয়েছিল বিকেলে তার কাছ থেকে কেউ একজন ম্যাগাজিন আর আনারসের মতন বোমা (গ্রেনেড) গুলো নিয়ে যাবে। এখনও আসে নাই। রজব এগুলো নিয়ে সালাউদ্দিনের বাসায় আর ঢুকবে না। লেকের পাড়ে লুকিয়ে রাখবে, যাতে কেউ না দ্যাখে। কিন্তু এর আগে ওকে নিশ্চিত হতে হবে যে অঙ্ক স্যারের লোকজন আসবে কিনা।

রাত নেমে গেলে রজব আর দেরি করে না। সব গুছিয়ে ভারী বাক্সটা নিয়ে উঠে পড়ে। লেকের পথে হাটা দেবে, এমন সময় পেছন থেকে একজন ডাক দেয়, ''রজব, একটু শুনে যাও।''

রজব পেছনে তাকায়। সকালের ওই দুই বুড়ো। দুইজন একসাথে কি করে? আর ওর নাম জানলই বা কি করে?

বুড়োদের একজনের আসল চেহারা
 কিছুক্ষন পরে চিনতে পারে রজব। দাড়ি গোফ পড়ে ছদ্মবেশ ধরেছে। একজনের বয়স তিরিশের বেশি হবে না, আরেকজন...

'কিরে চিনেছিস?'

রাজুকে ওর চিনতে ভুল হয় না। ওদের সাথে পড়ত। যুদ্ধ শুরু হলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবার আগে বাবা রজবকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করে রাজুর খোজ জানে কিনা। 'ঘরের চাবি তোদের মৌলভী স্যারের কাছে রেখে গেলাম। রাজুর সাথে দেখা হলে বলিস আমরা বর্ডারের কাছে চলে যাচ্ছি।' সাত মাস হয়ে গেল, এখনো তাদের কোন খোজ খবর নেই। 

এতদিন পর রাজুকে দেখে তাই রজবের ভেতর অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করে। সে রাজুকে ভালভাবে দেখে।ছেলেটার নতুন দাড়ি-গোঁফ উঠছে, হালকা রোয়া রোয়া হয়ে আছে সারা মুখে। যে ছেলের থাপ্পড় খেলে দাঁত খোয়াবার ভয় ধরত সকলের, সেই ছেলের শুকনো শরীর দেখলে সবাই সবকিছু গুলিয়ে ফেলবে। মুখ আর সব যুদ্ধে যাওয়া ছেলেদের মতই মলিন, কিন্তু শক্ত, কোন অভিব্যক্তি নেই। পরিশ্রম নাকি যন্ত্রণা- কোনটা বদলাল ছেলেটিকে?

রাজুকে রজব ভালভাবে জাপ্টে ধরে। তারপর কাছে বসায়। অন্য লোকটা লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে থাকে। 

রাজু বলল, 'সব আছে তো?'

রজব তার বাক্সটা রাজুকে দেয়। রাজু ভেতরে টর্চ মেরে দেখে। 'বাহ্‌, এবার তো গ্রেনেড দুটা বেশি দিয়েছে! অবশ্য গতবারের তুলনায় এবার ব্যাপারটা অনেক বড়...'

রাজু বাক্সের ভেতর সব গুছিয়ে রাখে। 'স্যার বলেছিল তোর জামাগুলো নিতে। একটা লুঙ্গি আছে, এটা পড়, তোরগুলো আমাকে দিয়ে দে। কালকে তোর জায়গায় আমাকে বসতে হবে। আশা করি, হারামজাদারা আমাকে চিনতে পারবে না।'

রজব অবাক হয়। কিছু বুঝতে পারে না সে। কালকে রাজু কেন তার জায়গায়...

'বুঝিস নি?' রাজু হাসে। 'শোন, কালকে স্কুলের ভেতর পাকসেনাদের ক্যাম্পে বড়সড় অপারেশন হবে। তুই কালকে ক্যাম্পের সামনে বসবি না, বসব আমি।'

রজবকে পুরো বিষয়টা রাজু খানিকটা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। রজব না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে রাজুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কত কঠিন বিষয় বুঝে ফেলেছে তার বয়েসী একটা ছেলে, ভাবতেই রজবের কেমন কেমন জানি করে ওঠে।

কিছুক্ষণ পর রাজুর সঙ্গে থাকা আরেকজন রাজুকে ইশারা করে চলে যাবার জন্য। রাজু এবার রজবকে একটু আড়ালে ডাকে। 'রজব,' রাজু এবার একটু আপ্লুত কন্ঠে বলে, ' মা-বাবা, রুমকি, ঝুমকি কোথায় আছে জানি না। শেষ খবর যা পেয়েছি, তাতে ওরা তখনও বর্ডারে যেতে পারে নাই...।' রাজুর গলা ভারী হয়ে আসে, রজব পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে থাকে।

রাজু এবার একটু শান্ত হয়। হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটা রুমাল, একটা চিঠি আর একটা ছবি বের করে। 'এই দুটা জিনিষ তোর কাছে রাখ। পালাবার সময় বাবার রুমালটাই নিতে ইচ্ছে হয়েছিল।আর এই ছবিটা,' রাজু একবার দেখে আবার চিঠির ভাজে ঠিক মতন রাখে, 'আমাকে একজন বিদেশী সাংবাদিক তুলে দিয়েছিল। যত্ন করে রাখিস।' 

কথা শেষ করে রাজু চলে যাচ্ছিল। রজবের হঠাৎ মনে হল, চিঠিটার কথা রাজু বলে নি। 'রাজু, চিঠিটা?'

পেছন ফিরে রাজু বলল, 'ওটা? ওটা দীপিকার জন্য। দেখা হলে দিস।

রজব মনে মনে হাসে। এই কঠিন সময়েও রাজুর দীপিকার কথা মনে আছে ঠিকই। অদ্ভুত ছেলে।

--------------

এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত, ঠিক যেমনটা ঘটেছিল, ঠিক তেমনই। রাজুদের অপারেশন সফল হয় না। রজব পরদিন থেকে আবার জুতো পালিশের জন্য স্কুলের আশেপাশেই পুনরায় জায়গা করে নেয়। ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ প্রবল হলে মিলিটারী ক্যাম্প সরিয়ে অন্য একটা স্কুলে নেয়া হয়। ১৩ তারিখ মুক্তিযোদ্ধারা সালাউদ্দিনকে মেরে ফেলে। অন্য রাজাকারদের মেরে ফেলা হয় কিংবা তারা পালিয়ে যায়।

ঘটনা খুব দ্রুত বদলালেও রজব বদলে যায় নি। রজব আগের জায়গায়, একদম ঠিক স্কুলের সামনেই বসে। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি সেখানে চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝে হাউমাউ করে কাঁদে, কেউ দেখে, কেউ দেখে না। কেউ কেউ দেখেও না দেখার ভান করে। 
            
একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজুর জিনিষগুলো কি তার পরিবারের কাছে ফেরত দিয়েছিলেন কিনা। রজব আলী কিছু বলে নাই, খালি একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে যত্ন করে রাখা জিনিষগুলো আমাকে দেখিয়েছিলেন। রাজুর সেই ময়লা রুমাল, সেই ছবি, সেই চিঠি। রাজুর লেখা চিঠি। যার শুরুতে লেখা ' আমার মনের মানবী '...


বাকিটুকু পড়তে পারিনি, চোখ ভিজে গিয়েছিল। 


এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন। লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।

2 comments:

দারাশিকো said...

পড়লাম।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প, শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্টোরীতে আগ্রহ পাচ্ছি কম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টা আস্তে আস্তে মিথ হয়ে যাচ্ছে। আর বেশ একপাক্ষিক ব্যাপারস্যাপার, টিপিক্যাল চিত্রায়ন। এইজন্যই বোধহয় আগ্রহ কম পাচ্ছি।
এনিওয়ে, আপনার লেখায় এই সমস্যা আছে তা না, এমনি বললাম। গুড রাইট আপ। ভালো লাগল :)

Rubayet Khair Rushdi said...

অনেক ধন্যবাদ দারাশিকো ভাই।

আসলে এই জিনিষটা ফিল করছি, খুব ভীষণ ভাবে। এমনকি এভাবে লেখাটা লিখতেও চাইনা আমি, কিংবা আমার মত যারা নতুন লিখছে। আমরাও সত্য জানতে চাই, সঠিক ইতিহাসটাই তুলে ধরতে চাই সবার কাছে। কিন্তু ওই যে, যারা আজ সত্য আমাদের জানাবে, তারাই তো দ্বিধাবিভক্ত। সত্য জানার আগেই যদি সেটা মিথ্যার জট পাকানো সুতোর বাধনে আটকে যায়, তাহলে সেটা বের করাটা বেশ মুশকিলের কাজ।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দারাশিকো ভাই।

ঘুমনামা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...