Wednesday, April 3, 2013

আকাশের তারাগুলিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (প্রথম অংশ)

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জুন ২৭১৮৩৮এপ্রিল ৮১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের যে কজন দিকপাল রয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। বলা হয়ে থাকে, বাংলা গদ্যসাহিত্য তাঁর হাত ধরেই প্রাণলাভ করে।  তাঁকে সার্থক আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে গীতার ব্যাখ্যাদাতা হিসাবে, সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তিনি বিশেষ খ্যাতিমান। তার কর্মে এবং অসামান্য লেখনীর পারদর্শিতায় বাংলা গদ্যসাহিত্য আজ এতদূর পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছে।


বাংলা গদ্যসাহিত্যের স্রষ্টার জন্ম হয় পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁটালপাড়ায়। বাবা যাদবচন্দ্র ছিলেন একজন ডেপুটি কালেক্টর। শ্যামাচরণ ও সজীবচন্দ্রের পর তার জন্ম। বাড়ির বাইরে নয়, পাঠশালার হাতেখড়ি হয়েছিল রামপ্রাণ সরকারের হাতে। কিন্তু বেশিদিন পড়লেন না, ভর্তি হলেন ইংরেজী স্কুলে (১৮৪৪ সালে)। ছোটবেলা থেকেই মেধার পরিচয় দিচ্ছিলেন বঙ্কিম। কাজেই শিক্ষকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। 

১৮৪৯ সালে বঙ্কিম ভর্তি হন হুগলি কলেজের স্কুল ডিভিশনে। সেখানেও তার স্বভাবজাত প্রতিভার নিদর্শন দেখাতে সক্ষম হন তিনি। পড়ার প্রতি তার ঝোঁক ছিল না তেমন। কিন্তু স্রষ্টার দেয়া অসাধারণ প্রতিভাবলে উতরে যেতেন প্রতিবার। শ্রী অরবিন্দ লিখেছেনঃ
বিদ্যালয়ে তিনি দ্রুত এক একটি শ্রেণি অতিক্রম করে যেতে লাগলেন; এত অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে করতে লাগলেন যে, তাঁর শিক্ষকরাও তাঁর জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন, এই অতিরিক্ত পঠনপাঠনে তাঁর দুর্বল শরীর না একেবারে ভেঙে পড়ে। তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে তাঁরা তাঁর উচ্চতম শ্রেণিতে প্রবেশ আটকে রেখেছিলেন। তবে ভাগ্য সবসময়ই বঙ্কিমের অনুকূল ছিল। উচ্চশিক্ষা হল সেই অসুর যার পায়ে আমরা ভারতের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বলি দিয়েছি। বিদ্যালয় জীবনে বঙ্কিমের অভিভাবকের তৎপরতায় তিনি এই দানবের খপ্পরে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। আবার হুগলি কলেজে পড়ার সময় তাঁর নিজের পরিশ্রমবিমুখতা তাঁকে এর হাত থেকে রক্ষা করেছিল। হুগলি কলেজেও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির খ্যাতি মেদিনীপুরের মতোই হয়েছিল। এবং অবশ্যই তাঁর লেখাপড়ার গতিপ্রকৃতি ঠিক মানবীয় ছিল না। পুরস্কার বা স্বাতন্ত্রতার খ্যাতির লোভ তাঁর ছিল না। কিন্তু যেখানে অন্যেরা শত পরিশ্রমেও কুল পেত না, সেখানে এক অলৌকিক নিস্পৃহতার মাধ্যমে তিনি নিজের সম্মানটি জয় করে নিয়েছিলেন; যেন কতকটা দৈবঘটিতের মতো।

সাধারণ পারদর্শিতার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকে কলেজ থেকে পুরস্কৃত করা হয়। ১৮৫৪ সালে তিনি কলেজ বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৮৫৫ সালের পরীক্ষায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক ২০ টাকা হারে বৃত্তি পান।
১৮৫৬ সালের ১২ জুলাই বঙ্কিমচন্দ্র আইন পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৫৭ সালে আইন বিভাগ থেকে অ্যান্ট্রান্স পরীক্ষার প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৮৫৮ সালের ১১ ডিসেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বঙ্কিমচন্দ্রকে বিএ উপাধি প্রদান করা হয়। হুগলি কলেজে ভর্তির আগেই ১৮৪৯ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে মোহিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। 

কিন্তু এই বিবাহ স্থায়ী হল না। মোহিনী দেবী মারা যান মাত্র ১৬ বছর বয়সে। পরবর্তীতে বঙ্কিম আবার বিয়ে করেন হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষ্মী দেবি কে। 

তার জীবনের একটা বিরাট সময় কেটেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হয়ে সরকারী চাকুরি করতে করতে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় তার বাবার মতই ব্রিটিশরাজের অনুগত ছিলেন।বাংলাদেশের যশোর, ঝিনাইদহে যেমন থেকে গেছেন, ঠিক তেমনি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, কোলকাতা, বারুইপুর, মুর্শিদাবাদে চাকুরি করেছেন। অবসর নেন ১৮৯১ সালে, সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ।

শেষ বয়সে তার শরীর তেমন ভাল ছিল না। বহুমুত্র (Diabetics) রোগে তার শরীর ভেঙ্গে পড়ে। এই মহান প্রতিভা মৃত্যুবরণ করেন ১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল। 

মারা যাবার আগে বংকিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। তার নাম উচ্চারিত হওয়া মাত্রই আমাদের চোখে ভেসে আসে বাংলা সাহিত্যের সার্থক ঔপন্যাসিকের নাম। 'দুর্গেশনন্দিনী' তার প্রথম বাংলা উপন্যাস এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস বলতে এটিকেই বিবেচনা করা হয়। সংস্কৃতের উপর অসাধারণ দখল ছিল তার, কাজেই দুর্গেশনন্দিনীর মাঝে আমরা খুঁজে পাই অপূর্ব ভাষাচয়ন,  জগৎসিংহ ও তিলোত্তমার অসাধারণ মিলনকাহিনী। কেবল প্রেমাখ্যান নয়, ঐতিহাসিক দৃশ্যপটে লেখা ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক গদ্যরচনার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক। 

বঙ্কিমের পরবর্তী উপন্যাসের নাম কপালকুন্ডলা। এককথায় একটা অসাধারণ উপন্যাস। 'পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?' বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক সংলাপ সেসময় বাঙ্গালীর মনে দাগ কাটে নাই, সেটা বলা কঠিন। বঙ্কিম আমাদের মাঝে কপালকুন্ডলাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এভাবেই, তার স্বভাব্জাত পবিত্র কিন্তু শিহরণ জাগানিয়া ভাষায়ঃ

সেই গম্ভীরনাদি বারিধিতীরে, সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া অপূর্ব রমণীমূর্ত্তি! কেশভার - অবেণী সম্বন্ধ, সংসর্পিত, রাশীকৃত, আগুণফলম্বিত কেশভার; তদশ্রে দেহরত্ন; যেন চিত্রপটের উপর চিত্র দেখা যাইতেছে। অলকাবলীর প্রাচূর্যে মুখমণ্ডল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ হইতেছিল না - তথাপি মেঘবিচ্ছেদ নিঃসৃত চন্দ্ররশ্মির ন্যায় প্রতীত হইতেছিল। বিশাল লোচনে কটাক্ষ অতি স্থির অতি স্নিগ্ধা, অতি গম্বীর অথচ জ্যোতির্ম্ময়; সে কটাক্ষ, এই সাগর হৃদয়ে ক্রীড়াশীল চন্দ্রকিরণ লেখার ন্যায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল দীপ্তি পাইতেছিল। কেশরাশিতে স্কন্ধদেশ ও বাহুযুগল আচ্ছন্ন করিয়াছিল। স্কন্ধদেশ একেবারে অদৃশ্য; বাহুযুগলের বিমলাশ্রী কিছু কিছু দেখা যাইতেছিল। রমণীদেহ একেবারে নিরাবরণ। মূর্ত্তি মধ্যে সে একটি মোহিনী শক্তি ছিল, তাহা বর্ণিতে পারা যায় না।
এরপর একে একে আসে মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরার মতন রোমান্টিক সামাজিক উপন্যাস। মূলত বিষবৃক্ষ ছিল তার রচিত প্রথম সামাজিক উপন্যাস।বিধবাবিবাহ আর বহুবিবাহ তার এই উপন্যাসের মূল আলোচ্য ভাবধারা বা theme. তিনিই সচেতন ভাবে বিধবাদের বিষবৃক্ষ রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, 
বিষবৃক্ষে বিধবা বিবাহের কুফল দেখানো হয়েছে। অবশ্য এ উপন্যাস রামনারায়ণ তর্করত্নের 'কুলীনকুলসর্বস্ব' বা 'নবনাটক' নয়, উমেশচন্দ্র মিত্রের 'বিধবাবিবাহ'-ও নয়। কেবল বিধবাবিবাহের সামাজিক কুফল দেখানোর জন্য বঙ্কিমচন্দ্র এ উপন্যাস রচনা করেননি। তা যদি করতেন তা হলে তাঁকে প্রশংসার বিল্বদলে পূজার প্রয়োজন হত না। তা হলে এটি নিছক উদ্দেশ্যমূলক উপন্যাস হত। পুরুষের দুর্বল হৃদয়ের পরাজয় এবং সেই পতন থেকে আত্মরক্ষার কথা এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। বিষবৃক্ষের বীজ কখন অজ্ঞাতসারে সুগোপনে মনের মাটিতে উপ্ত হয় তা আমরা বুঝতে পারি না, যখন সে তরু পুষ্পিত পল্লবিত হয়ে আমাদের সদসৎ বোধ ও বিবেকবৃত্তিকে হরণ করতে উদ্যত হয় তখনই আমাদের চেতনা হয়। তখন অনুতাপ ছাড়া আর কিছুই হাতে থাকে না।... আধুনিক জীবনের দ্বন্দ্বমুখর এই উপন্যাস, এই জাতীয় রচনার প্রথম বার্তাবহ।  



এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন।লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।

No comments:

ঘুমনামা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...