Saturday, June 2, 2012

টুসকি ও তারা দুইজন

'আচ্ছা, ধর, আমরা সবাই মিলে যদি গর্জ্যেস ম্যলিসের জন্মদিন পালন করি, তবে কেমন হয়?'

নাবিলের এই প্রশ্ন শুনে বিষম খেলাম।'গর্জিয়াস মালিশ!! সেইটা আবার কি?'

নাবিল আমার কথা শুনে ভ্রু কূঁচকাল।' ধুর ব্যাটা মালিশ বলছিস ক্যানো? ম্যলিস্‌ ম্যলিস্‌-গর্জেস্‌ ম্যলিস! ফ্রান্সের বিখ্যাত ১০ জন ফিল্ম ডিরেক্টরদের একজন। হুগো দেখিস নি বুঝি?'

সকালে ক্যান্টিনে খেতে বসেছিলাম। এত্ত জ্যাম ঠেলে যখন ভার্সিটি পৌছাই তখন খিদের চোটে মাথায় কিছু থাকে না। এমনিতেই ক্ষুধায় কাতর, তার উপর নাবিলের হঠাৎ প্রশ্নে বিষম খেলাম।

নাবিল আমার সামনের চেয়ারটা ঠেলে বসল। ' শোন। ধর আজকে তুই এমন একটা কাজ করলি, যেটার কথা আজ থেকে ৯০ বছর পরও লোকে স্মরণ করছে। তখন তোর কি মনে হবে?'


'আমার?' আমি কি আর এমন কিছু লেখা থাকবে, যেটার জন্য কিনা ৯০ বৎসর লোকে মনে রাখবে? বড়জোর ট্যাক্স, ভূমি জরিপের লোকজন আর যদি বিয়ে-থা করি, তাহলে হয়ত নাতি-পুতিরা মনে রাখতে পারে। এর বাইরে মনে রাখার মত লোকজন আমার আশেপাশে নেই, এব্যাপারে গ্যারান্টি দেয়া যেতে পারে।

তবুও চিন্তিত ভঙ্গিতেই আমি বললাম, 'তখন আর কি মনে হবে...ভালই লাগবে।'

'এইটাই বলছিলাম!' নাবিলের উৎসাহ আরো বেড়ে যায়, সে একদম আমার কাছে ঘেষে বসে। তার সবসময়কার আলসে চোখে একটা জলন্ত দিয়াশলাই কাঠির আলো দেখতে পাওয়া যায়। সে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে, ' আমার মনে হয় এই ধরণের প্রতিভাবান লোকদের নিয়ে কিছু করা দরকার। এই জায়গাটায় একটা প্রাণ আছে, একটা লাইফ আছে, বুঝলি? এখানে যদি গর্জেস্‌ ম্যলিস্‌, এরিখ্‌ রোমার, ব্যর্তুলুচ্চি, ভিস্‌কোন্তে, হিচকক্‌-এদের নিয়ে যদি সামথিং একটা কিছু যদি করা যায়, তবে একটা ব্যাপক সাড়া পড়ে যাবে!'

আমার তখন তলপেটে সাড়া পড়ে গেল। আমি ওকে চিন্তিত মুখে বললাম, ' ব্যাপক চিন্তার বিষয়...নাবিল, আমার ব্যাগটা একটু ধরবি? টয়লেটে যাব।' ও আমার ব্যাগ হাতে দাড়িয়ে রইল, মুখে চিন্তার ছাপ।

টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে দেখি সে তখনো ওইভাবে দাঁড়িয়ে আছে,হাতে ব্যাগটাকে অদ্ভুতভাবে ঝোলাচ্ছে। আমি আমার ব্যাগের ভেতরের মুল্যবান জিনিষপত্র এবং আমার জীবনসঙ্গী ল্যাপটপের কথা ভেবে দ্রুত ব্যাগটা হাতে নিয়ে কেটে পড়লাম।

ল্যাবের সামনে এসেই দেখি চিকনার আগমন। 'চিকনা আমাদের সাথে পড়া একটা অসম্ভব ট্যালেন্ট'- ওর কথা বলতে গেলে লায়লা সবসময় এই কথাটা বলবেই। 'যেই ব্যাটা নিজে আরেকজনকে ক্যালকুলাস বুঝিয়ে দেয় , সে কিভাবে পরপর দুইবার ম্যাথ ১০১ এ ফেল করে?'

সেই চিকনা (বাপ মা যার নাম দিয়েছিল ইকবাল) ওরফে ইবু আমার সামনে এসে একটা গুরুগম্ভীর পোজ দিয়ে বলল, ' আজকে বাসের মধ্যে যেই মেয়েটা পাশে বসল, তাকে দেখে কি মনে হল জানিস?'

ইকবালের মনে নারী বিষয়ক চিন্তা কেন আজকে? আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি?'

"দেশের নারীরা আজকাল পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে।"

আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাসেল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আমি কিছুক্ষণ তার চেহারার দিকে তাকিয়ে বললাম, ''আমি তো ঠিক বুঝলাম না...''

' বুঝলিনা! আরে, পাশের মেয়েটা এসএমএস লিখল তার অর্ধেকই ভুলে ভরা। have বানান লিখতে গিয়ে দুটা শব্দ নাই, tomorrow লিখতে গিয়ে morrow লিখে তার আগে ২ লিখেছে। আর যে কত সব ভুলভাল শব্দ লিখেছে, তার কোন শেষ আছে? এভাবে যদি চলতে থাকে তবে দেশটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, ভেবেছিস? '

আমি আর রাসেল ততক্ষণে মনে মনে হাসতে হাসতে খুন। আমি হাসি চেপে ইবুকে বললাম, ' ইবু শোন, ওইটা আসলে এসএমএস লেখার একটা শর্টহ্যান্ড হয়ে গেছে , সবাই আজকাল ব্যবহার করে, শুধু মেয়েরা নয় সবাই ইউজ করে। তুই এটা নিয়ে ভাবিস না।'

''ওহ্‌,'' ইবুকে দেখে মনে হয় মনে মনে শান্তি পেল। আমিও নিস্তার পেয়ে ল্যাবের ভিতরে ঢুকতে গেলাম। পরক্ষনেই দেখি, ইবু আবার আমার জামার হাতা ধরে টানছে। আমি বললাম, 'আবার কি হল?'

''আচ্ছা, বাংলায় লেখার জন্য এরকম কোন শর্টহ্যান্ড আছে দোস্ত?''
আমি চিন্তা করে বললাম, 'নাই। ক্যান, কি হইসে?'
ইবু চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। আমার প্রশ্নের জবাব দেয় না। আমিও আবার ল্যাবে ঢুকে যাই।

আমার এই দুই বন্ধুকে নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নাই। এদের দুই জনের প্রেক্ষাপট থেকে এরা দুজনই অবিরাম গতিতে চিন্তা করতে থাকে। এদের চিন্তার মাত্রাটা আসলে কাছে থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না। অথচ, দুইজনই একটা জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছে, বের হতে পারছে না। অনেকটা খাঁচায় থাকা কুমিরের মতন আরকি...।

ইবুর সাথে যেদিন দেখা হয়, সেদিন ওকে দেখে ভদ্র ভোলাভালা চেহারার বালকবিশেষ বলেই মনে হয়েছিল। আমরা একসাথে বাসায় যেতাম, নিজেদের অনেক কথা জমে ছিল বলে প্রথম কয়দিনে সেগুলোই ভ্যাজর ভ্যাজর করতাম । কিন্তু যখনই ও ওর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তার কথা আমাকে বলতে শুরু করল, তখন সেগুলো চিন্তা করতে গিয়েই আমার মাথা আউলে যেত। আমি ভাবতাম, ছেলেটা তো জিনিয়াস! আমিও তার চিন্তায় না বুঝে সায় দিতে লাগলাম। কয়েকদিন পর তার পরীক্ষার পাতায় প্রতিভার বিকাশ দেখে আমার চিন্তা বাড়তে লাগল। এই ছেলেটা এত কিছু জেনেও পরীক্ষার খাতায় এরকম লাড্ডু পায় কেমন করে?

'' আসলে ওর জানাটা সব পড়ার বাইরের বিষয়," সার্কিট সাজাতে সাজাতে মুমিন বলে। ' পড়াশোনা নিয়ে ওর চিন্তা খুব কম। আর মহামানবেরা এসব নিয়ে চিন্তা করে নাকি? '

মাসুদ অবাক হয়ে বলে, ' তাই নাকি? ইবু শালাটা মহাপুরুষ হয়ে যাবে? বলিস কি?'

মুমিন বিরক্ত হয়ে যায়, ' হলই বা, তাতে তোর কি? ভাগ এখান থেকে! '

মুমিনের বকা শুনে মাসুদ একটু মন খারাপ করে। যেতে যেতে পেছন ফিরে বলে, ''আমাকে এভাবে বললি মুমিন? আমি মাইন্ড করলাম কিন্তু...'' মুখটা মাসুদ কাঁদো কাঁদো করে ল্যাবের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। '' নাহ্‌, ছেলেটা আর শুধরালো না,'' বলতে বলতে মুমিন মাসুদকে আটকাতে চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাব করতে থাকি।

নাবিলের সাথে পরিচয়টা কিভাবে সেটা একটু মজার। নাবিল একজন অলিখিত ফিল্ম ডিরেক্টর। ওর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হচ্ছে শিল্পমন্ডিত ছবি, আমরা যাকে বলি আর্ট ফিল্ম। । ছোট বেলা থেকেই ও এত্ত এত্ত ছবি দেখেছে যে, ওর কাছে এই ছবি বানানো আর ছবি দেখাটাই জীবনের সব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও ছবি বানানোর চেষ্টা করছে, দু একটা বানিয়েছে। ঘন্টায় ঘন্টায় ফেসবুকে দুই একটা গুরুগম্ভীর ফিল্মী স্ট্যাটাস দেয়, দেখলে মনে হবে এই ছেলে এইমাত্র হলিউড থেকে উড়ে এসেছে ।

নাবিলের অবসর কাটে মুভি দেখে আর পরীক্ষার আগে সময় কাটে এই মুভিগুলোর বিষয় নিয়ে আজব আজব চিন্তা করতে করতে। ধরা যাক, ও বসে বসে কোন একটা সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্য দেখছে। হয়ত নায়ক নায়িকাকে প্রেমের প্রস্তাব করার পর নায়িকাকে নিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে। এই দৃশ্য নাবিলকে আন্দোলিত করবে। সে এই সিনের একটা কন্টেম্পোরারী বিশ্লেষণ শেষে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে নায়িকার এই আইসক্রিম খাওয়ার দৃশ্য বদলে অবশ্যই একটা ঝালমুড়ি খাওয়ার দৃশ্য দেখাতে হবে। নইলে এই সিনেমার মূল মজাটাই নষ্ট!

এসব অদ্ভুত চিন্তার কথাগুলো সে আমাকে তার ভাঙ্গাচোরা ল্যান্ডলাইন দিয়ে জানায় (তার মোবাইলে কখনোই ব্যালান্স থাকে না, শেষ কবে সেলফোনে টাকা ছিল সেটা আমি মনে করতে পারছি না,মনে করতে সময় লাগবে)। আমি টেলিফোনের অপর প্রান্তে বসে এসব শুনি আর ঝিমুতে থাকি। আমার কানে এসব কথা ঢুকছে কিনা সেটা আবার নাবিল মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখে। 'এই, বলত আমি এই মাত্র কি বলেছি?'

আমি ঘুমকাতুরে গলায় বলি, ' কোন বিষয়ে?'
' শেষ কি বললাম বলত?'
আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে থাকি। নাবিল ধমক দেয়, ' শালা! আমি এইখান থেকে কত কথা বলে যাচ্ছি, আর তুই ওপাশে ঘুমাচ্ছিস?'
আমি অজুহাত খুঁজি, ' নারে, আজকে খালি ঘুম পাচ্ছে রে...''
নাবিল গম্ভীর গলায় বলতে থাকে, ' এসব কথার মানে বুঝবি না তুই। বুঝতে পারলে তোকে দিয়ে কিছু একটা হত, এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাতি না। রাখলাম।'

আমি ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে নাবিল এভাবেই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

তবে এই দিনেরও পরিবর্তন ঘটেছিল।

তখন আমরা ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দিচ্ছি। পড়াশোনা কিচ্ছু হয় নাই, পড়ীক্ষার আগে পড়লে যেরকম হয় আরকি, হাতে-মুখে কিছু পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছি আর ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছি- কখন জানি একটাতে ফেল করে বসি।

তো যাই হোক, একটা দুটো করে দিতে দিতে চারটা পরীক্ষা শেষ। সবার শেষে ছিল ম্যাথ ১০২(ইবু এইটাতেও ফেল করে, সেটা কেন এখন বোঝা যাবে)। আমি ঘরে বসে প্রাণপনে অঙ্ক কষছি আর হিসেব কষছি, আমার পড়া বাকি আর কদ্দুর। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, পানি খাচ্ছি আর ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রাণপনে পড়ছি। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

এমন সময় ইবু ফোন করল। ' কিরে, সব শেষ?'
আমি বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললাম,' ফুরিয়ার পড়ি না এখনও। দোস্ত কিচ্ছু পারি না, আমি রাখি।'
'আরেহ্‌ রাখিস না, রাখিস নাহ, কথা আছে,' ইবু একটু সিরিয়াস গলায় বলে। আমি বিরক্ত হয়ে বলি, 'কি?'
'আমার শিক্ষাজীবনে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটতে চলেছে।'
শিক্ষাজীবনে বিশেষ ঘটনা? আমি বললাম, 'কি ঘটনা? বৃত্তি-টিত্তি পাইসিস নাকি?'
' আরে নাহ্‌,' ইকবাল আমার কথা উড়িয়ে দেয়, 'ওসব কিছুই না।'
' তাহলে?'
কথাটা বলার জন্য কিছুক্ষণ সময় নেয় ইবু। তারপর বলে, ' আমার একটি মেয়েকে ভালো লেগেছে।'

আমি কথাটা শুনে আরেকটু হলে পড়েই গিয়েছিলাম। বলে কি? এই ছেলে করবে প্রেম? আমি ভাল করে ধরলাম ওকে, ' কে মেয়েটা?'
' আরে, ওই মেয়েটা...'
আমি ধাঁধায় পড়লাম, '...কোন মেয়েটা?'
' ওই যে, আমার পাশে এখন যেই মেয়েটা পরীক্ষা দেয়...'

কথা শুনে আমার একটু হাসি পেল। মেয়েটাকে ওর সাথে দাড়ালে লম্বায় ওর চেয়ে চার ইঞ্চি লম্বা মনে হয়। আমি তবুও হাসি চেপে বললাম, 'তাই?'

' হু...।'
' তা ওকে বলেছিস যে ওকে তোর পছন্দ হয়েছে?'
ইকবাল কিছু বলল না। আমি বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললাম, ' ওকে না বললে তো কিছু হবে না।'
ইকবালকে একটু কাতর শোনায়, ' তাহলে?'
' তাহলে আর কি? তোর প্রথম প্রেমের এইখানেই ইতি...'
' আরে ভাই,' ইকবাল অসহায় গলায় বলে, ' একটা উপায় বল না!'
আমি চুপচাপ ক্ষানিক ভেবে বললাম, ' এক কাজ কর, কালকে পরীক্ষা তো শেষ, তাই না? কালকে ওকে তোর কথাটা বল। দেখ ও কি বলে...'
আমার কথা শেষ না হতেই ইকবাল মানা করে দিল। ' না না, আমি বলতে পারব না। তুই বল।'
' আমি বলব মানে? আমি কি ওরে পছন্দ করসি নাকি, করসিস্‌ তো তুই!'
' না...আমি পারবোনা ভাই, ও আমার দ্বারা হবে না...'
আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, ' কিছুই হবে না, ওর পছন্দ হলে হবে, নাইলে নাই...'
'মানে?' ইকবাল আরো আতংকিত হয়ে যায়,' নাইলে নাই মানে? আমি কি এখানে অংক কষতে বসেছি যে হলে হল, নাহলে হবে না?'
' আরে, বিষয়টা সেরকম নয়...' বলতে বলতেই লাইন কেটে গেল। আমি আর কি করব, ফুরিয়ার পড়া শুরু করলাম।

সে রাত্রটা প্রায় না ঘুমিয়ে সকালে পরীক্ষা দিলাম। টানা তিন ঘন্টা অঙ্ক করে কোনরকমে খাতায় লিখে যখন হল থেকে বের হলাম, তখন দেখি হলের সামনে ইকবাল দাঁড়িয়ে। সাথে ওই মেয়েটা।

আমি এগিয়ে এসে দাড়াতেই ইকবাল হাসিমুখে আমার সামনে এসে দাড়াল।' বন্ধু, পরিচয় করিয়ে দেই। এ হচ্ছে সাবরিনা টুসকি। টুসকি, এ আমার বন্ধু।'

মেয়েটা হাসিমুখে আমার সাথে হাত মেলাল। আমি তো অবাক। আমার সাথে কথা বলল, জিজ্ঞেস করল পরীক্ষা কেমন দিলাম। আমিও হাসিমুখে জবাব দিয়ে ইকবালকে ইশারায় জিজ্ঞেস করি,' বলেছিস তো' ? ও আমার কথার জবাব না দিয়ে হাসে। ওর হাসি দেখে আমি একটু গোলকধাধায় পড়ে যাই। তবে আর ঘাটাই না, কোন প্যাচ আবার লাগিয়ে ফেলি সেই ভয়ে।

ইকবাল আমাকে দাড়াতে বলে,' এখনই যাস না, কিছু আলোচনা আছে।' কথার মানে না বুঝে ওদের পাশে দাড়ালাম। মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলাম। আসলেই, তেমন খারাপ না, ভালই দেখতে। গায়ের রঙ ময়লা হলেও চেহারাটায় একটা সৌন্দর্য আছে। ইকবালের পছন্দ খারাপ না তাহলে...

নাবিল কোথা থেকে জানি হাজির হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম পরীক্ষা কেমন হল। ' পরীক্ষা আমার দ্বারা হবে না। তিনটা অংক দিয়েছি, এতে যদি মটু প্রফেসরের মন গলে'। ইকবালের দিকে ফিরে বলল, ' কিরে, কি জন্যে ডাকলি?'

ইকবাল ঠোটের কোনে চিকন একট হাসি দিল।'তোর একটা শর্টফিল্মের জন্য নায়িকা খুজছিলি বলছিলি না?'
' হ্যা,' নাবিল চোখের কোন দিয়ে টুসকির দিকে তাকায়।'পেয়েছিস নাকি?'
' এই যে, তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। টুসকি, পরিচিত হও।'

টুসকি সেরকম একটা ফিল্মী হাসি দিয়ে নাবিলের সামনে দাঁড়ালো। আমার তো ওদের কাজ কর্ম দেখে আক্কেল গুড়ুম। ইবু প্রেমিকা ঠিক করতে গিয়ে নায়িকা ঠিক করে এসেছে!

' ফিল্মে আমার কাজ করার অনেক শখ,' টুসকি লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে নাবিলকে বলে। নাবিল তখন লাট্টুর মতন চোখ নিয়ে টুসকির কথা গিলছে। ' কত সিনেমা দেখে কেঁদেছি, কত সিনেমা দেখে মনে হয়েছে আমার এইরকম একটা রোল যদি পেতাম... '

নাবিল বিনয়ের সাথে বলে, ' দেখুন, সিনেমা বলুন, আর ফিল্ম বলুন, যেটা থাকতে হবে, সেটা হলো ডেডিকেশন। এই ডেডিকেশন না থাকলে এগুলো আপনার দ্বারা হবে না, নিশ্চিত থাকুন। কিছু করার প্রেরণা থাকতে হবে। সত্যজিতের কথাই ধরুন না। পথের পাঁচালী করতে গিয়ে কি পরিমাণ কন্ট্রিবিউশন...''

নাবিল তার নায়িকাকে ফিল্ম বোঝাতে থাকে। আর ইকবাল বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকে-চোখে স্বপ্নের ঝিলিক।

তিন চার দিন পর আমি নাবিলকে ফোন দেই, কিছু ছবি ওর কাছ থেকে নিয়ে দেখব বলে। ফোন দিতেই শুনি অনেক চেঁচামেচির শব্দ। আমি বললাম, ' কিরে, তুই কোথায়?'
' বসুন্ধরায় যাচ্ছি, জ্যামের মধ্যে বসে আছি।'
' বসুন্ধরায় কেন? কারো বাসায় যাচ্ছিস নাকি?'
' না না,' নাবিল হালকা তেলতেলে ভাব এনে বলে, ' টুসকিকে একটু লোকেশন দেখাতে নিয়ে যাছি।'
আমি টুসকির কথা শুনে টাসকি খেয়ে যাই। ' টুসকি তোর সাথে লোকেশন দেখতে গিয়েছে?'
' হ্যা, কেন, ওকে নিয়ে গেলে কি সমস্যা?'
আমি ইবুর আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখলাম। তাড়াতাড়ি করে বললাম, ' দেখ, তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল, এখনই শুনতে হবে...'
পাশে টুসকির কথা শোনা যাছে বলে মনে হল। ' পরে কথা বলব দোস্ত,' নাবিল ফোন রেখে দেয়।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরে, ভার্সিটি যখন খোলা, তখন দেখি ইকবাল হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা মনমরা। আমি ভাবলাম, ম্যাথের রেজাল্ট টা ভালো হয় নাই দেখে মনে হয় মন খারাপ। আমি কাছে গিয়ে বলি, ' কিরে ইবু, তোর মন খারাপ নাকি?'

ইবু বাংলা পাঁচের মতন চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সায় দিল। আমি কাধে হাত দিয়ে বলি,'ও কিছু না। একটা দুইটা ক্যারী না খেলে ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টিয়ারিং ধরতে পারবি না। সামনের বার পরীক্ষা দিস ভালো করে।'

' আমি পরীক্ষার জন্য মন খারাপ করেছি সেটা তোকে কে বল?' ইকবাল বিরক্ত হয়ে আমাকে বলে।
আমি আবার ধাঁধায় পড়ে যাই, ' তাহলে?'
' আর বলিস না,' ইকবালের গলায় হতাশা, ' কত কষ্ট করে হারুণ ভাইয়ের কাছ থেকে এই দামী ক্যামেরাটা এনেছি, অথচ টুসকির কোন দেখাই নেই!'
' ক্যামেরা দিয়ে কি হবে?' আমি জানতে চাই।
' না মানে, টুসকির নাকি ভালো ছবি তোলা নেই। আমি ভাবলাম, আমি যদি কিছু ছবি তুলে দিতে পারি, তাহলে দেবী যদি তুষ্ট হয়...'

' তাহলে কি? তোকে বর দেবেন?' আমি বিরক্ত হই। ওকে বলি, ' শোন শালা, তোর দরকার কনে, বর-ফর দরকার নাই। তুই এখনও কেন ওকে কিছু বলছিস না কেন? না বললে কি হবে ভেবেছিস?'
ইবু কিছু করে না, চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্যান্টিনের ভেতরে দুপুরের কোলাহল। আমরা এই ভীড়ের মাঝে চুপচাপ এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকি।

আমি চিকনাকে বুঝাই, ' ওকে বলে দে। দেখ ও কি বলে।'
' আমি পারব না...' ইকবাল কাঁদো কাঁদো মুখে বলে।
' এখন না বললে...'
' ইকবাল ভাই...!' বলতে বলতে হঠাৎ করে আমাদের সাবজেক্ট ই কোথা থেকে জানি হাজির হল। আর অমনি ইকবালের মুখে সেই স্বপ্নালু আবেশ এসে পড়ল, মুখে সেই শান্তি শান্তি ভাব। ইকবাল সাবরিনা টুসকির সাথে কথা বলতে বলতে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে গেল। আমি আর কি করব, বসে বসে চুইংগাম চিবুতে লাগলাম।

এমনি করে দিন যায়। আমাদের ক্লাস চলে। কখনো নাবিলকে, আবার কখনো ইকবালকে ক্লাসে দেখা যায় না। ইকবাল টুসকির জন্য ফুল নিয়ে আসে, চকোলেট খাওয়ায়, বেড়াতে চলে যায়। আর নাবিল তাকে অদ্রে হেপবার্নের কথা শোনায়, ইউ হ্যাভ গট এ মেইলের ডিভিডি উপহার দেয়, লোকেশন দেখাতে দেখাতে নিজেই ডিজলোকেটেড হয়ে যায়।

ভালোই চলছিল সব। কিন্তু একদিন সবকিছু ডিটারজেন্ট পাউডারে ধোয়া কাপড়ের মতন পরিস্কার হয়ে গেল।

সকালে আমি এসেই দেখি ইকবাল নেই। বুঝলাম, নিশ্চয়ই টুসকিকে নিয়ে বাইরে গেছে। ওদিকে স্যার এটেন্ডেন্স নেবার সময় দেখি নাবিলও ক্লাসে নেই। আমি তো চিন্তায় পড়লাম। চট করে ইবুকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি,' কোথায় তুই?'

' আজকে আমার জন্য একটা বিশেষ দিন,' ইবুর কথায় ভীষণ খুশির ছাপ। ' আজকে সাবরিনার জন্মদিন!'
আমি বলি, ' ভালো তো। তা তুই ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলি নাকি?'
' না, তার চেয়েও দারুণ খবর। রাজকন্যা আমাকে তার বাসায় নেমন্তন্ন করেছে!'

ও...এই ব্যাপার। আমি জিজ্ঞেস করলাম, '  তোকে একা জানালো নাকি আর কাউকে জানাইসে?'
ও আমার কথা উড়িয়ে দেয়, ' ফুঃ, আর কাকে ডাকবে? খালি আমাকেই ডেকেছে। শোন, আমার ফিরতে রাত হবে, তুই আমার বাসা থেকে ফোন করলে বলে দিবি যে আমি আজ তোর বাসায় থাকব।'

আমি ফোন রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের ক্লাসের জেরিন আমার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাছে এসে ওর মোবাইল ফোনটা আমার কানে ধরিয়ে দিল। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নাবিলের গলা, ' কিরে, ফোনে কি কল সেন্টার চালাচ্ছিস? ফোন ঢুকছে না কেন? আর ঢুকবেই বা কেন? যতসব বিদেশী ফোন কোম্পানীর সিম ব্যবহার করিস...'

' আমি আসলে ইবুর সাথে কথা বলছিলাম।'
ইবুর কথা শুনেই নাবিল চট করে জিজ্ঞেস করল? ' ইকবাল? ইকবাল কোথায়, হোয়্যার ইজ হি?'
' কেন? ইবুকে দরকার কেন?'
' আরে, আমি টুসকিকে খুঁজে পাচ্ছি না।'
সেরেছে। ' কিন্তু ওকে কেন দরকার তোর?'
' আরে তুই জানিস না?' নাবিলকে অধৈর্য্য মনে হয়, ' আজকে আমার ওকে নিয়ে একটা মিউজিক ভিডিওর শ্যুটিং করার কথা, কিন্তু ওর কোন পাত্তাই নেই! কত করে বলে দিলাম সকাল সকাল এসে পড়তে...আসছেই না।'
' আসলে হয়েছে কি...' আমি নাবিলকে বোঝাই, ' সম্ভবত টুসকির আজকে জন্মদিন, বাসায় পার্টি-টার্টি আছে বোধহয়।এই জন্যেই মনে হয় আসতে পারছে না।'
হঠাৎ নাবিলের মুড বদলে গেল, ' জন্মদিন? আগে বলবি না...বোকা মেয়ে,' নাবিল বিড়বিড় করতে থাকে, ' আমাকে বলল না...এই শোন, আমি রাখি, আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।'

আমি বুঝতে পারি নাবিল কোথায় যাবে। তবু জিজ্ঞেস করি, 'কোথায় যাবি?'
' কোথায় আবার, টুসকির বাসায়,' বলে ফোনটা রেখে দেয় নাবিল। আমি ফোন হাতে শঙ্কিত হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। জেরিন কৌতুহলী চোখে এতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার ফোন রাখা হলে জিজ্ঞেস করে, 'ঘটনা কি?'
আমি উত্তর দেই না। ঘটনাটা যে আসলে কোন দিকে গিয়েছে সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

এরপর দুই তিনদিন নাবিল কিংবা ইকবাল-কেউই ক্লাসে থাকে না। নাবিলের বাসায় ফোন দিলে বলে ও নাকি কয়েকদিনের জন্য খালার বাসায় গেছে। আর ইবুর মোবাইল বন্ধ। আমি চিন্তিত সময় কাটাই আর স্টিভেনসনের পাওয়ার সিস্টেম এনালাইসিস নিয়ে উদাস মনে বসে থাকি।

তিন চারদিন পর গেটের সামনে সাবরিনার সাথে দেখা। আমি ওকে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, 'কি খবর টুসকি, কেমন আছ?'
টুসকি আমাকে দেখে হাসিমুখে বলে, 'কেমন আছেন ভাইয়া? আপনাকেই তো খুজছিলাম। ওইদিন আপনি এলেননা কেন? আপনার বন্ধুরা এল, আপনি কই ছিলেন?'
' আমি আসলে তোমার জন্মদিনের ব্যাপারটা জানতাম না...'
' কি যে বলেন না ভাইয়া,' টুসকি আমার কথা কেড়ে নেয়, ' আমার জন্মদিনের কথা পুরো ভার্সিটি জানে আর আপনি জানেন না! এটা একটা কথা হল?'
আমি কিছু বলি না, মুচকি মুচকি হাসি। হঠাৎ দেখি মুখটা কালো করে টুসকি বলে, ' আচ্ছা, আপনার বন্ধুদের সমস্যা কি বলুনত? সেদিন দুইজনেই আমার জন্মদিনে আসল, আর আমার হাজব্যান্ডকে দেখেই ওনাদের মুখটা শুকিয়ে গেল? '

' হাজব্যান্ড?!?' আমি কথা শুনে থ মেরে গেলাম। এই মেয়ে বিবাহিত?

' হ্যা, হাজব্যান্ড ই তো। কামালের সাথে আমার এন্‌গেজমেন্ট গত এপ্রিলে হয়েছে...'
কামাল নামটা শুনে একটু সন্দেহ হয়, আমি বলি, ' কামালটা কে?'
' আরে, আপনি তো আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না দেখি...' টুসকি বিরক্ত হয়, ' কামাল হচ্ছে আপনাদের ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। আপনাদেরকে ডিএলডি শেখায়...'

আমার হাতের থেকে মরিস ম্যানোর বইটা অল্পের জন্য পড়ে যায় নি।

এই ঘটনার পর ইকবাল আর নাবিল আবার নিজেদের জগতে ফিরে যায়। আমি মাঝে মাঝে ওদের দিকে তাকাই আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি। মোবাইল থেকে মমতাজ আপা চিৎকার করে বুক ফেটে যাবার কথা বলেন।

প্রেম জিনিষটা ভয়াবহ সুন্দর, তাই না?






এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন।লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।

ঘুমনামা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...