Wednesday, June 27, 2012

ক্যাম্পাস || সকাল থেকে দুপুর আর একজন নাফিসের গল্প

সকালবেলা বাইরে থাকা একসারি চায়ের দোকান থেকে ভার্সিটিটাকে দেখতে খারাপ লাগে না। আমি মাঝে মাঝে বসে বসে হারুন মামার দোকানে চা খাই আর ভার্সিটিকে ভালো করে দেখি। চার বছর আগে যেমনটা দেখতাম, এখনো তেমনটাই আছে, তেমন একটা বদলায় নি। তবে বদলাচ্ছে কোথাও, কোথাও একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই। সেটা খুজতে হবে...উত্তর হয়ত আছে আমাদের সামনেই।

বাইরে বসে বসে চা খেতে খেতে হাতের বইটা দেখছিলাম, পরীক্ষা আছে কিছুক্ষণ পর। খুব বেশি পড়া যে হচ্ছিল, তা কিন্তু নয়, কিন্তু কেন যেন পরীক্ষার আগে বইটা (বইয়ের চাইতে নোটের পরিমাণ বেশি ) না দেখলে ভাল লাগে না। বইয়ের তেতো পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে আশেপাশে তাকাচ্ছি, এমন সময় সামনে দেখি ছোটখাট জটলা। ছেলেগুলোর চেহারাই বলছে ছেলেগুলো নতুন (নতুন, কারণ পুরোনদের মত বইয়ের ভারে চুল পড়ে যাওয়া মোটা হয়ে যাওয়া চেহারা নয়, চিকন, লিকলিকে কৈশোর পেরোন পেরোন ভাব,অনেকেরই আবার চোখে চশমা ওঠে নি। এদের দেখলেই অন্তুত বলে দেয়া যায় ফার্স্ট ইয়ার )। আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই কোন বিষয়ে নিজেরাই কথাবার্তা বলছে, বড়দের সাথে কথা বলার সময় পাঁচ-সাতজনের বেশি একসাথে আসে না। আমি পড়তে লাগলাম। কিন্তু সবাই যখন চুপ করে কথা শুনতে শুনতে হেসে দিল, এবং জোরে জোরে বলতে লাগল 'পাওয়ার, পাওয়ার!' তখনই আমি বুঝতে পারলাম, ইহা আর কেউ নয়, আমাদের পাওয়ার নাফিস সেখানে উপস্থিত আছেন।

আমি নাফিস ভাইয়ের কাছে গেলাম। রীতিমত আসর জমে গেছে সেখানে। বড় ভাইদের দেখলে ছেলেদের মাথা যেখানে এক বিটের মেমোরী হয়ে যায়, সেখানে সবাই ৩ গিগাহার্জ প্রসেসিং স্পিডে নাফিস ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলছে। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ একমনে কথা গিলছে, কেউ মোবাইল দিয়ে নাফিস ভাইয়ের ছবি তুলছে। দুই একজনকে দেখলাম হাল্কা বিরক্ত। তবুও দাঁড়িয়ে আছে, যেন কোন একটা কিছু ঘটার অপেক্ষায় আছে।

নাফিস ভাই আমার চেয়ে এক সেমিস্টার বড়। গত তিন সেমিস্টার ধরে বলছেন, এই সেমিস্টার শেষ হলেই নাকি ওনার অনার্স শেষ হয়ে যাবে। তবে এই সেমিস্টারে এসে তিনি আমার সাথে, এবং আমি এবারও ভয় পাচ্ছি, সঠিক সময়ে ওনার সেমিস্টার শেষ হবে কিনা!

এরকম মানুষ ভার্সিটিতে আমি খুব কম পেয়েছি। ছেলে হিসেবে উনি মারাত্মক ভাল। আরিফের ভাষায় 'এক্কেরে জেনুইন পোলা। সাতে পাঁচে নাই, তুমি একটা কথা কইবা, জান দিয়া ফালাইব তোমার জন্য। খালি ওনাকে একটা চা আর হারুন মাম্মার টং থেকে একটা বিড়ি খাওয়াতে হইবেক। তারপর তোমার কাজ শেষ, খেইল খতম।'

তবে পড়াশোনার কাজ ওনাকে দিয়ে কখনো হয় নাই। ওনার বৃহৎ জ্ঞানের জায়গা কেন যেন পড়ার বাইরের জগৎটাতে চলে গিয়েছে। সারাদিন কিসব কিসব কঠিন কঠিন বই পড়েন, পত্রিকার অর্থনীতির পাতাটায় চোখ বোলান সবচে' বেশি। চোখের চশমাটা পড়ে মনে হবে ভুলে মাইক্রস্কোপিক জগতে চলে এসেছি। সব মিলিয়ে ওনাকে গিক বললে ভুল হয় না। ওনাকে আমাদের ডিপার্টমেন্টে ঢোকা নতুন টিচার ল্যাবে ওনাকে বলেছিলেন, তোমাকে দেখলে ত মনে হয় তুমি সারাদিন পড়, কিন্তু তুমি তো কিছু পারছ না! ওনার জবাব ছিল এমন ''দেখেই যদি সব কিছু সহজ মনে হবে, তাহলে আপনাকে তো আমার সহজেই ছোট বোন বলা উচিত!" বলা বাহুল্য নতুন ম্যাডাম চার বছরে পাশ করলেও নাফিস ভাই পারেননি। একারণেই হয়ত তিনি এরকম একটা জবাব দিতে পেরেছিলেন...।

আমাকে দেখে নাফিস ভাই এগিয়ে আসলেন, ''আরে...দেখ কে আসছে এখানে। দেখ দেখ, তোমাদের বড় ভাইরাও সামনে এগিয়ে আসতেসে। আরো আসবে দেখবা। আমাদের কাজ শুরু হলে আরো সবাই আসবে...''

আমি হেসে বললাম,''কিসের কাজ নাফিস ভাই?"
নাফিস ভাই একটু অবাক হয়ে বললেন, ''ওমা তুই জানিস না? আজকে সকালে গেটের সামনে নোটিসটা দেখিস নাই?''

পাশের থেকে একটা গোলগাল ছেলে বলল,''নোটিসটা নাই ভাইয়া, কে যেন ছিড়ে ফেলেছে...''
''ছিড়ে ফেলেছে?'', নাফিস ভাইয়ের চেহারায় একটু হতাশা চলে আসল বলে মনে হয়, কিন্তু কি ভেবে আবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়, বলে, 'ও কিছু না, আমাদের কাজ দেখলে সবাই আস্তে আস্তে এগিয়ে আসবে।''

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ''কাজটা কি আসলে?''
''ব্যাপারটা হচ্ছে,'' বলতে বলতে নাফিস ভাই একটা পোস্টার বের করলেন,"এইটা"।আমি দেখলাম তাতে লেখা আছেঃ

"সার্বজনীন ভালবাসা নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি

ভালবাসা পাপ নয়, আশীর্বাদ
আমাকে ভালবাসুন, আমি আপনাকে ভালোবাসব
আসুন ভালবাসি, ভালবাসতে শিখাই।"

অবাক হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এইটা দিয়ে কি হবে?

''কি হবে মানে?'' নাফিস ভাই এবার উত্তেজিত হয়ে যান,''এই পৃথিবীতে মানুষের মাঝে ভালবাসা কমে যাচ্ছে। আমাদের মাঝে ভালোবাসা খুব কম রে ভাই, আমরা এখন খালি গুম-হত্যা,রাহাজানি, পুশব্যাক শুনতেসি, ভালোবাসার গল্প শুনিনা। আমাদের দেশের মানুষের মনে এখন অনেক কষ্ট জমা আছে। এগুলো দূর করতে ভালোবাসা দরকার।''

আমি চুপ করে শুনলাম, আসলে কি বলব মাথায় কাজ করছিল না। কিছুক্ষণ পরে বললাম, ''আপনি এখন কি করবেন ভাই?''
''কি করব মানে? মৌন মিছিল করব, প্রতিকী অনশন করব, প্রয়োজনে হরতাল করব! ভালবাসার জন্য সব করতে রাজি আছি।''

একে কি এখন পরীক্ষার কথা বলা যায়? তবুও বললাম,''নাফিস ভাই, আজকে পরীক্ষা ছিল একটা...''
''পরীক্ষা? কোন পরীক্ষা?''
''মোবাইল সেলুলার...''
একটু অবাক হয়ে বললেন,''তাহলে কালকে কি দিলাম?''
''অপ্টো ইলেক্ট্রনিকস্‌..., নাফিস ভাই চলেন। পরীক্ষা দিবেন।"
নাফিস ভাই আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দিলেন। বললেন, ''বালক তুমি যাও তোমার চেনা পথে, আমি আসছি, আসছি আমার দোমড়ানো রথে...।'' আমি তার বারো কথার তেরো গলি-ঘুপচি বুঝতে না পেরে গেটের পথেই এগুলাম, ক্লাসে আগে আগে গেলে যদি কিছু জিনিষ রিভাইস দেয়া যায়...।

ইউনিভার্সিটির বিশাল সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেখি আমার সামনে ইয়া বড় ভুড়ি নিয়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। উপরে তাকিয়ে দেখি জামাল স্যার, তার রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে বললাম,''স্লামালিকুম স্যার...''

''ওয়ালাইকুম। তুমি ইলেক্ট্রিক্যাল ফোর-টু না?''
স্যার জানল কিভাবে? যাই হোক, জবাব দিলাম,''ইয়েস স্যার।'
''শোন, তোমাদের ক্লাসের একটা ছেলে আছে না সারাদিন হাতটাকে একটা রেকট্যাঙ্গেলের মতন করে রাখে...''
আমি শুধরে দিলাম, ''ক্যামেরা ফ্রেমের মতন করে রাখে...''
''ওই হল আর কি। শোন, ওকে একবার আমার কাছে আসতে বলবা তো, খুব জরুরী।''
''জ্বি স্যার বলব। আমি যাই স্যার?'' আমি আসলে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভয় পাচ্ছিলাম, ভদ্রলোকের আবার যেখানে সেখানে বিরাট বিরাট লেকচার দেবার অভ্যেস আছে।
''যাও।'' বলে চলে যেতে যেতেই হঠাৎ কি মনে করে পেছন ফিরে ডাক দিলেন,'এই ছেলে?''
আবার কি হল? ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে বললাম,''জ্বি স্যার?''
''ওকে বলবা ওর ক্যামেরাটা অবশ্যই যেন নিয়ে আসে।''
''আচ্ছা,'' বলেই একটা দৌড় দিলাম। ভদ্রলোকের কাছে থাকাটা সুবিধের লাগছে না।

স্যার আসলে আকাশকে খুজছে। আকাশ ছবি তোলে। খুব ভালো ছবি তোলে যে তা না, মাঝে মাঝে ছবির 'ছ' ও তুলতে পারে না। তবে তার একটা ভালো ক্যামেরা ও ছবি তোলার একটা ভালো ইচ্ছে আছে, আশা করা যায় ভালো ছবি তুলতে পারবে।

ক্যাফেটেরিয়ার সামনেই আকাশকে খুজে পাওয়া গেল। সিড়ির গোড়ায় আকাশ তার চিরাচরিত হাত দুটোকে দিয়ে ফ্রেম ধরে বসে আছে আর তার বান্ধবী নীলা বিরস মুখে টেবিল টেনিস গ্রাঊন্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আকাশকে বললাম,'কিরে, সারাদিন কি ওর ছবিই তুলবি নাকি?''

ও মুখ না তুলেই জবাব দিল, ''...কেন, ওইদিন না তোদের ছবি তুলে দিলাম?''
আমি পাশে বসতে বসতে বললাম, ''না, মানে বলছিলাম, আরো কেউ তো বলতে পারে, তাই না?''
''কানের ওখানটাই কি সুন্দর আলো পড়েছে দেখেছিস?" আকাশ নীলার কানের কাছে ফ্রেমিং করতে করতে বলে। "একটা ক্যামেরা থাকলে বেশ হত! কি নাম দেয়া যায় ছবিটার? মায়াবী সৌন্দর্য?"

"ছাতা সৌন্দর্য!'' নীলা ধমক দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ''সকাল বেলা আমাকে উত্তরা থেকে টেনে নিয়া আসছ এই সৌন্দর্য বুঝাতে, না!''

নীলা গট গট করে ক্যান্টিনের দিকে হাটতে থাকে। ''আরে, আমি কি করলাম,' বলে মৃদু আর্তনাদ করে থেমে যায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে,''কি ব্যাপার, এখন বল কি হয়েছে?"

''জামাল স্যার তোকে ডেকেছেন।''
''জামাল স্যার!'' আকাশ অবাক হয়,''উনি আমাকে চেনেন নাকি?"
''হ্যা, তোমার এই হাতের চতুর্ভুজকেন্দ্রিক ক্রিয়া উনার স্মরণে আছে বলেই মনে হয়,'' আমি চিন্তিত মুখে বললাম।
''হুম,'' আকাশ কি যেন চিন্তা করল, মুখে একটু ভয় ভয় ভাব। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,''আমি তো কিছু করি নাই রে, আমাকে ডাকল ক্যান?''
''আমি কি জানি? আমাকে বলল, তাই বললাম।সাথে ক্যামেরা নিয়ে যেতে বলল।''
''ও...। আচ্ছা, ঠিক আছে। পরীক্ষা দিবি না?''
আমি ঊঠতে উঠতে বললাম,''হুম, চল''

ক্লাসে গিয়ে দেখি সব সীট বুকড্‌। কোথায় গিয়ে যে বসব, বুঝতে পারছিলাম না। শেষে মাসুদের পাশে বসলাম। মাসুদ ঠোটের নিচে বিড়বিড় করে দুলে দুলে দোয়া পড়ছে। কিছুক্ষণ পর দুপ করে বুকের মধ্যে বার তিনেক ফুঁ দিয়ে নিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,''কিরে, পড়সিস?''
আমি ক্ষানিকক্ষন ভেবে বললাম,''প্রশ্নের উপর ডিপেন্ড করে। সহজ হলে মোটামুটি নাম্বার পাব।''
মাসুদ আমার হাত ধরে বলল,''আমাকে একটু দেখাইস ভাই, কিচ্ছু পারি না...''
আমার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেল। রাগার ভান করে বললাম,''এতক্ষন দোয়া পড়ছিস ক্যান? আমারটা দেখে দেখে যাতে লিখতে পারিস?''
আমার কথা শুনে মাসুদের মুখটা আস্তে করে গোমড়া হয়ে গেল।আমার পাশের থেকে উঠেই যাচ্ছে এমন একটা ভাব। আমি হেসে বললাম,''ধুর বোকা! আমি তো মজা করছিলাম..."। ও আমার পাশে মুখ গোমড়া করেই রইল।

পরীক্ষা শুরুর বিশ মিনিট পর দেখি নাফিস ভাই হাজির। এসে প্রশ্ন আর পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসলেন। ডিউটিতে থাকা স্যার কাছে এসে বললেন,''পাঁচ মিনিটে তুমি কিছু লিখতে পারবে?'' জবাবে নাফিস ভাই মুখ তুলে বললেন,''বাংলা সিনেমায় পুলিশ কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসেই কেস সলভ করে যায়। কিভাবে করে স্যার বলুন তো?'' স্যার কথার মারপ্যাচ বুঝতে না পেরে খালি বললেন, ''লিখ, লিখ, খালি কথা বলে ছেলেটা!"


পরীক্ষা শেষ করে আকাশ জামাল স্যারের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে গেল। আমি নাফিস ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম,''কেমন হল?''

হাসিমুখে বললেন,''খুব ভাল। সবাই খুব এপ্রিশিয়েট করছে, আমি তো মনে হয় সাকসেস্‌ফুল হয়ে গেলাম...''
''আরেহ নাহ! পরীক্ষা কেমন হল সেটা জিজ্ঞেস করলাম...''
''পরীক্ষা? দেখ ভাই,'' চশমা খুলে মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে যেতে যেতে বললেন,''পরীক্ষা কোন আমার জন্যে নয়, পরীক্ষা দেবার লোক অনেক আছে। আমি তো অনেক কিছু নিয়ে ভাবি, আমাকে অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। এই সব পরীক্ষা আমাকে দিয়ে হবে না...''

বলতে বলতেই ধুম করে একটা মেয়ের গায়ে পড়ে গেলেন নাফিস ভাই। মেয়েটাও পড়ে গেছে। আমি পুরোন দিনের কম্পিউটারের মতন হ্যাং হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সম্বিৎ ফিরে পেতেই আমি নাফিস ভাই আর মেয়েটাকে তুলে বসালাম। বসেই প্রথমে মেয়েটা নাফিস ভাইকে ঠাস করে একটা চড় লাগাল। নাফিস ভাই তো থ। আর আমার কথা তো বাদই দিলাম, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মেয়েটা চলে যাবার পর কাঁদোকাঁদো গলায় ভাইয়া চশমাটা পড়ে বললেন,''আমার কি দোষ? চশমা ছাড়া আমি দেখতে পাই নাকি?''

আমি জবাব দিলাম না, হতাশ হয়ে আস্তে করে ওনাকে তুলে টয়লেটের দিকে চলে গেলাম, বেচারার জামাকাপড় সব ময়লা হয়ে গেছে।

রাত্রে আকাশ ফোন দিল। ওর কথা শুনে খুশি খুশি লাগল, আমি জিজ্ঞেস করলাম,''কি হলো, খুব মৌজে আছ মনে হচ্ছে?''
''আর বলিস না,''আকাশের মুখে হাসি।''আজকে জামাল স্যার কেন ডেকেছিল জানিস?''
''কেন?''
''ওনার মেয়ের দুটা পোট্রেট ছবি তুলে দিতে, বিয়ের বায়োডাটার জন্য।''
অবাক না হয়ে পারলাম না,''কি বলিস!! ওনার মেয়ে আছে? কি করে?''
''ডাক্তারনী, ডাক্তারনী, মাত্র এমবিবিএস পাস করল। পাত্র খুজছে। আমাকে দেখে স্যারের বাসায় সবাই খুব আদর যত্ন করল।''একটু থেমে আকাশ আবার বলল,'' স্যার নিজেও বেশ মাই ডিয়ার লোক। আমাকে অবশ্য দুইতিন বার সিজিপিএ জিজ্ঞেস করে লজ্জা দিল ঠিকই, নইলে খুব ভালো লাগল।''

''তাই নাকি? এমনিতে কিন্তু মনে হয় না...। আচ্ছারে, আমি রাখলাম।''

রাতে নাফিস ভাই আবার ফেসবুকে চ্যাটে আমাকে দুঃখের ইমো সহকারে জিজ্ঞেস করলেন,''আমি কি করলাম, যে আমাকে এত জোরে থাপ্পর মারল?''

আমি বললাম, ''আমি কেমন করে বলব ভাই? মনে হয় মেয়েটা আপনাকে ভুল বুঝেছে...।'' কিছুক্ষন পর আবার লিখে পাঠালাম, ''দেখলেন, আপনার প্রতি তার কোন দয়ামায়াই হল না, সোজা আপনাকে থাপ্পর দিল? আসলে কারোই দয়ামায়া নাই ভাই, আপনি আপনার ভালবাসার কর্মসূচি করতে যাবেন, দেখবেন, এরকমই কিছু হবে, কেউ আপনাকে বুঝবে না।''
নফিস ভাই লিখল ''কি বলিস তুই! আমি তো আরো এনার্জি পাচ্ছি এটা করার জন্য(উত্তেজনার ইমোটা খুজে পান নাই, নইলে মনে হয় ওইটাও দিতেন)। আমি তো এদেরকেই বোঝাতে চাই, ভালবাসা কতটা দরকার মানুষের জীবনে।আমার কর্মসূচি চলবে। শোন, কাল সকালে ভার্সিটির সামনে একটা মানব্বন্ধন করছি, তুই অবশ্যই আসবি।''

''চেষ্টা করব ভাই, তবে শিউর না,'' বলে অফলাইন হয়ে গেলাম।

পরদিন সকালবেলা। গেটের সামনে এসে দেখি ভাংতি টাকা নাই। কি বিপত্তি! এদিকে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে, রিকশাওয়ালাকে ভাড়াও দিতে পারছিনা...। এমন সময় দেখি মাসুদ পাশের রিকশা থেকে নামছে। আমি বললাম,''মাসুদ আমার রিকশাভাড়াটা একটু দিবি? ভাংতি নাই আমার কাছে।''
মাসুদ মানিব্যাগ হাতড়ে বলল,''আমার কাছে পাঁচ টাকা আছে,হবে?''

''নারে...'' আমি অগত্যা হারুন মামার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাড়া দিলাম।কিছুক্ষণ পর স্টেশনারীর দোকানে গিয়ে ফটোকপি করতে দিতে গিয়ে দেখি মাসুদ চুপে চুপে হাসছে। আমি একটু সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,''কিরে? হাসিস ক্যান?''

ও দেখি মুচকি হাসছে। যতই জিজ্ঞেস করি, কিছু বলে না। পরে আমি ক্লাসে চলে আসলাম। এসে দেখি ও এস এম এস পাঠিয়েছে ''গত রবিবার আমাকে ক্যান্টিনে খাওয়াইলে তোমাকে রিকশাভাড়াটা দিতাম।'' সাথে জিহবা বের করা ইমোর চিহ্ন। শালা আমাকে শুধু শুধু কষ্ট করাল।

ক্লাস শেষে মাসুদ ক্লাসরুমে এসে বলল,''কিরে, প্রক্সি দিয়ে দিসিস?''
প্রক্সি? আমি জিজ্ঞেস করলাম,''কখন বললি?''
মাসুদ মুখ গোমড়া করে বলে,''তোকে না এসএমএস এর নিচে লিখে দিলাম?''
আমি এসএমএস টা ভালো করে দেখলাম। সবার নিচে লিখেছে, ওইটুকু দেখার আগেই মেসেজ পড়ে শেষ করেছি আমি । কি আর করব, কাতর ভাবে বললাম,''স্যরি রে...আমি আসলে খেয়াল করি নাই...''
মাসুদ এবার উত্তেজিত হয়ে বলে ,''খেয়াল করিস নাই? একটা এসএমএস খেয়াল করিস নাই?'' কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছিল, হাসতে পারছিলাম না, যদি আবার কিছু বেকায়দায় বলে বসি? 

কিন্তু বিধি বাম। "আসল কথা কি জানিস? আসলে তুই আমাকে বন্ধুই মনে করিস না...,'' বলে মুখটা লোডশেডিংয়ে অন্ধকার বাড়ির মতন করে বের হয়ে গেল।

মন খারাপ করে বসে রইলাম। আমি এই ছেলেটাকে এখনও ঠিকমতন বুঝতে পারি না, দোমনা মানুষ, নাকি সরল-সোজা? 

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আর ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে লক্ষ করতে করতে দেখি আকাশ কোথা থেকে জানি দৌড়ে আসছে। চোখেমুখে হন্তদন্ত ভাব, হাতে ক্যামেরা। আমার সামনে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,''আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে! স্যারের মেয়ের ছবিগুলো যেই মেমোরী কার্ডে তুলেছিলাম, সেটা কাজ করছে না!''

''কই দেখি,'' আমি কিছু বলার আগেই নীলা আগ বাড়িয়ে বলল। মেমোরী কার্ডটা হাতে নিয়ে একবার দেখে ল্যাপটপে লাগালো। ''কই,'' নীলা ভালো করে দেখে বলল,''ঠিকই তো কাজ করছে। ছবি তুলতে তুলতে তোমার মাথাটা ঘুরে গেছে বুঝেছ!'' আকাশ দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। আমি হাসব কিনা না বুঝে চুপ করে রইলাম।

ক্লাস শেষ, আমরা বের হয়ে প্লাজায় আসলাম। রৌদ্রজ্জ্বল দিনের অর্ধেকটাই শেষ হতে চললো। এই জায়গাটার স্মৃতিগুলো আজকাল কেন যেন মনে আসে। ভর্তির সময়কার কত উৎকন্ঠার রেশ, কখনো আনন্দোৎসবের ছোয়ায় আপ্লুত, কত রাগ-ক্ষোভ এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে পুষেছি। কত বৃষ্টিভেজা দিনে একলা ভিজে অস্থির, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছি কত। এই শেষ সময়টায় স্মৃতিগুলো আবার কেন যেন ফেরত আসছে। আনমনে বলি,"আমরা কত্ত বড় হয়ে গেলাম, তাই নারে নীলু?"

নীলা চুপ করে আকাশের সাথে হাটতে থাকে। আমিও চুপচাপ হাটতে থাকি। এমন সময় আকাশ সামনে তাকিয়ে কি যেন দেখল। দেখেই অবাক হওয়া গলায় বলে ,''দেখ তো, ওইটা নাফিস ভাই না?''

টং দোকানগুলোর সামনে নাফিস ভাই দাঁড়িয়ে। কড়া রোদ, এর মাঝে উনি কি করছেন?

আমি আকাশ আর নীলা কে আস্তে আস্তে গেটের কাছে আসতে বললাম,আমি আগে আগে হেঁটে ওনার কাছে চলে গেলাম।

কাছে যেতেই হাতে আর গলায় পোস্টার দেখেই বুঝলাম, এইটা ওনার সেই মানববন্ধন কর্মসূচি। নাফিস ভাইয়ের জন্য কেন যেন মায়া লাগল। বেচারা কালকে এতগুলো ছেলেকে আসতে বললেন, অথচ কেউ এল না। কাউকে অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমি নিজেই আসলাম না...।

এই ঝলসানো রোদে লোকটা হাতে একটা পোস্টার আর গলায় একটা ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চেহারা লাল হয়ে আছে, দেখলে যে কারো কষ্ট হবে। কাছে যেতেই নাফিস ভাই তার চিরচেনা হাসি দিয়ে বললেন,''এই তো লক্ষী ছেলে, এসে পড়েছ। নাও এটা একটু ধরো তো হাতটাতে ঝিম লেগেছে। একটু নেড়েচেড়ে নেই।হারুন মামা, একটা চা দেন তো, চিনি ছাড়া হবে,'' বলে হাতের প্ল্যাকার্ডটা আমার হাতে দিলেন। কালকের সেই প্ল্যাকার্ড। ঘামে কালিগুলো থেবড়ে যাচ্ছে,পড়া যাচ্ছে না প্রায়। 

আমি ব্যানার রেখে দিতে নিতেই উনি বাধা দিলেন,''আরে আরে, রাখিস কেন? ওইটাই তো দেখাতে হবে।''

''লেখাটা পড়া যাচ্ছে না নাফিস ভাই...,'' কথাগুলো বলে আমার কেন যেন বুকটা খাঁ খাঁ করতে থাকে।

''পড়া যাচ্ছে না কে বলছে? শোন,'' আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,''এই যে আমি ভাবছি সবাইকে ভালোবাসতে হবে, এতে কি সবাই ভালোবাসবে সবাইকে? কেউ হয়ত ভাববে, পাগল হয়ে গেছি, মেয়েদের চোখে পড়তে চাচ্ছি, আরো কত্ত কি...।'' একটু থেমে নিয়ে মুখটা শক্ত করে বললেন,''আমার দেশে এখন সব কিছু নিয়ে ব্যবসা হয়, সব কিছু নিয়ে চাঁদাবাজি হয়। সবাই নিজেকে বেহায়ার মতন দেখিয়ে বেড়ায়, বলে, আমিই সব, আমাকে দেখ,আমার কাছ থেকে শেখ। কিন্তু আমরা কি কখনো হারুন মামার মতন চায়ের দোকানদারদের কথা ভেবেছি, যে কিনা একদিন দেশের জয় যুদ্ধ করে এখন চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালায়? কিংবা ওই ছেলেটার কথা ভেবেছি যে কিনা খেটে কিছু করার চাইতে কাকরাইলের মসজিদের সামনে গিয়ে ভিক্ষে করাকে লাভজনক মনে করে? এসব নিয়ে ভাবতে হবে, কাউকে না কাউকে ভাবতে হবেই। আজ হোক, আর কাল হোক।''

চুপচাপ কথাগুলো গিলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কোথায় যেন আটকে যাচ্ছিল। হারুন মামা নিঃশব্দে চা বানাচ্ছেন, চোখে পানি। আকাশ আর নীলা চুপচাপ এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। নাফিস ভাই একা দাঁড়িয়ে রইলেন। হাতে শক্ত করে ধরা সেই পোস্টার, মুখে শপথের ছায়া।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা, হঠাৎ দেখি কালকের মেয়েটা এসে হাজির। আমি তখন বকা দেবার মুডে ছিলাম না, কিন্তু এই মানুষটাকে কিছু বলার দায়টুকু মেয়েটাকে নিতেই হবে। কিছু একটা বলব বলে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার দিকে।

মেয়েটাকে দেখে নাফিস ভাইও অবাক। তিনিও কিছু বলতে চাইলেন, তার আগেই মেয়েটা বলল, "আমি আসলে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আপনি যে দেখেননি, সেটা আসলে আমি পরে বুঝতে-''
তাড়াতাড়ি মেয়েটার কথা থামিয়ে দিলেন নাফিস ভাই। হাসলেন। বললেন ''আমিও না দেখে হাটছিলাম। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।''
মেয়েটা হাসল, কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর অবাক হয়ে বলল,''কিন্তু আপনি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?''
''আমি? আমি আসলে দাঁড়িয়ে আছি ভালোবাসার জন্য।''
'' ভালোবাসার জন্য মানে?''
আমি আর শুনলাম না। কাহিনী কোনদিকে গড়াচ্ছে অনুমান করে আকাশকে ডাকলাম, "আকাশ, আয় আমার সাথে।''
কিন্তু আকাশ তখন দাঁড়িয়ে গেল।ক্যামেরা বের করতে করতে বলল, '' এই মুহুর্তে নাফিস ভাইয়ের যেই ফ্রেম পাওয়া গেছে , সেইটা আর কখনো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!" ক্যামেরা নিয়ে ঝটপট নাফিস ভাইদের ছবি তোলা শুরু করল।

আমি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে এগুতে লাগলাম। পথেই দেখি মাসুদ মুখ বেজার করে বসে আছে। আমি কিছু না বলেই চট করে হাসি থামিয়ে ফেললাম। রাগী মুখের ঝামটা মেরে বললাম, ''কি?"

মাসুদ মুখ গোজ করে পেছনের দিকে ইশারা করে বলল, ''এত্ত কিছু হুইল, আর আমারে একটা ডাক দিলি না? যাহ্‌ শালা মাইন্ড করলাম...।"

আমি কিছু বলার আগেই নীলু ওকে দোড়াতে লাগল, চেচাতে চেচাতে বলতে লাগল,''তোর এই মাইন্ডের খেল বন্ধ হইব কবে রে শয়তান! আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন..."

আমি ওদের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে হঠাৎ ভার্সিটির দিকে তাকাই। কেন যেন বিশাল দালানটাকে আমার বেশ ভালো লাগতে থাকে। অসম্ভব রকমের ভালো।
    








এই লেখার সর্বস্বত্ব লেখকের ।এই লেখা লেখকের অনুমতি ব্যাতীত প্রকাশ,মুদ্রণ,অনুলিখন কিংবা কোন রচনায় প্রকাশ করিলে লেখক আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে বাধিত হইবেন।লেখকের মৃত্যুর পর লেখাগুলির সর্বস্বত্ব লেখকের পরিবারের।

No comments:

ঘুমনামা

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা বসে আছি। একটা খালি মাঠের এক কোনে, বিলের পাশের নিচু ঢালে। শুয়েও পড়তে পারি, যদি ইচ্ছে হয়। তারপর কি করব জানি না। আমি অ...